দুর্গাপুর, ২০ নভেম্বর (হি. স.) : এ যেন অবিভাবক হীন রূপসী অরোণ্য। বন্যপ্রান সংরক্ষিত জঙ্গলের লালমাটির রাস্তায় অবাধে ছুটছে বালি বোঝাই লরি, ডাম্পার, ট্রাক্টর। উধাও সড়কের ওপর হাইটবার। ভারী যান চলাচলে বেহাল হচ্ছে জঙ্গলের রাস্তা। আতঙ্কে বন্যপ্রানী। নজরদারি শিকেয়। প্রশ্ন উঠেছে বন দফতর ও পুলিশ প্রশাসনের ভুমিকায়।
কাঁকসার জঙ্গলমহল বলতে শিবপুর, মলানদীঘি, বনকাটি এই অঞ্চলকে বোঝায়। পরিধি ৭ হাজার ৫০০ হেক্টর। শাল, মহুয়া, আম, জাম, কাঁঠাল, পেয়ারা, শিমূল, সেগুন, নিম, হরিতকি সহ নানান গাছ গাছড়ার সমাহার। দুষনমুক্ত ঘন জঙ্গল যেমন তেমনই রয়েছে জঙ্গলে হরিন উদ্যান, ময়ুর সহ নানান পশু পক্ষির আবাস স্থল। আবার মাঝে মধ্যে গজরাজেরও আগমন হয় এই জঙ্গলে। সম্প্রতি গভীর এই অরোন্যে নিল গাইয়ের দেখা মিলেছে। এছাড়াও মাঝেমধ্যে নজরে পড়ে নেকড়ে ও হায়নার। এরকম মনোরম পরিবেশের মাঝে সবুজ অরণ্যকে উপভোগ করতে উদ্যোগ নেয় পুর্ব বর্ধমান আঞ্চলিক বনবিভাগ। শিবপুর-দেউল জঙ্গলে পর্যটকদের পায়ে হেঁটে ট্রেকিং ব্যাবস্থা করেছে বনবিভাগ। শিবপুর থেকে দেউল পর্যন্ত রয়েছে ট্রেকিং রুট। জঙ্গলের বুক চিরে চলে গেছে লাল মোরামের রাস্তা। তার মাঝে জঙ্গলে বেশ কিছু মনোরম দৃশ্য। যা পর্যটকদের হাতছানি দেয়। বেশ কয়েকটি জলাশয়। যেখানে পরিযায়ী পাখিদের আগমন হয়। জঙ্গলেই রয়েছে বল্লাল সেনের প্রতিষ্ঠিত শ্যামারূপার মন্দির। যেখানে বছরে সবসময়ই পুণ্যার্থীদের আগমন হয়। প্রাচীন ওই মন্দির এলাকায় তৈরী করা হয়েছে ওয়াচ্ টাওয়ার। এছাড়াও রয়েছে অজয় নদীর তীরে দেউল পার্ক। সেখানে জমিদার ইছাই ঘোষের প্রতিষ্ঠিত প্রাচীন শিবমন্দির। পার্কের ভেতর বিশাল জলাশয়ে বোটিং ব্যাবস্থা, টয়ট্রেন। নানান ফুলের উদ্যান। পিকনিকের মরশুমে উপচে পড়া ভিড় হয় পিকনিক প্রেমীদের। তার পাশেই হরিন ও ময়ুরের বাটিকা। ২৮ হেক্টর এলাকাজুড়ে ওই বাটিকায় রয়েছে ৭৫ টিরও বেশী চিতল হরিন। এছাড়াও টিয়া, ময়ুর, বন বিড়াল, বন মোরগের মুক্তাঞ্চল। মাঝে মধ্যে দেখা যায় হুড়োলও। রয়েছে পেঙ্গোলিন। এছাড়াও হাতি থাকার অনুকুল পরিবেশ। গত ২০২১ সালে দেউলে নতুন করে বিশ্রামাগার তৈরী করছে বনবিভাগ। ১৪ লক্ষ টাকা ব্যায়ে ট্রেকিংয়ে আসা পর্যটকরা বিশ্রাম নেবে। সেখানে আবার রয়েছে ক্যান্টিন, আর্ট গ্যালারি, বনজ দ্রব্যের বিক্রয়কেন্দ্র। বন সংরক্ষণ কমিটির সদস্যদের তৈরী নানান হস্তশিল্পের সম্ভার থাকে। ওইবছরই বর্ধমান আন্তঃরাজ্য পাচারকারীদের হাত থেকে প্রায় সাড়ে ৭০০ টিয়া পাখি ও হিল ময়না আটক করে বন দফতর। আটক হওয়া ওইসব পাখির কিছু সংখ্যক দেউল জঙ্গলে ছাড়া হয়। বন সংরক্ষন আইন অনুযায়ী জঙ্গলের রাস্তা পাকা করা হয় না। তেমনই বন্যপ্রান সংরক্ষিত এলাকায় ভারী যান চলাচল নিষিদ্ধ। তারজন্য দেউল জঙ্গলের সড়কে লাগানো হয়েছিল হাইটবার। লাগানো হয়েছে সতর্কীকরন বোর্ড। কিন্তু, বন সংরক্ষন আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে জঙ্গলের রাস্তায় দিনরাত অবাধে ছুটছে বালি বোঝাই লরি,ডাম্পার, ট্রাক্টর। উল্লেখ্য, জঙ্গলের পাশে অজয় নদ। আর ওই অজয় নদের কাঁকসার কোটালপুকুর, কাজলাডিহি, শিবপুরে রমরমিয়ে চলছে অবৈধভাবে বালি পাচার। দিনদুপুরে ৫০-৬০ টি ট্রাক্টরে কোটালপুকুর ও কাজলাডিহি থেকে বালি বোঝাই করে জঙ্গল লাগোয়া মজুত করছে। আবার সন্ধ্যা নামতেই লরি ও ডাম্পারে ওইসব ঘাট থেকে বালি পাচার হচ্ছে। বালি বোঝাই লরি, ডাম্পার যাতায়াতে ভেঙে পড়েছে লাল মোরামের রাস্তা। খানাখন্দে ভর্তি। কোথাও আবার বড় বড় গর্ত তৈরী হয়েছে। আর তাতেই বিপন্ন সবুজ বনানীর বুক চিরে যাওয়া লাল রাস্তা। দিনরাত ভারী যান চলাচলে কার্যত ভয়ে সিটিয়ে সেখানের হরিন, ময়ুর সহ বন্য প্রানী। জঙ্গলে রয়েছে প্রচুর ময়াল সাপ। লকডাউনের সময় প্রায় রাস্তার ওপর নির্ভয়ে পারাপার করত। ভারি যান চলাচলে ওইসব সাপের প্রানহানির শঙ্কাও রয়েছে। বিজেপি নেতা সৌগত পাত্র বলেন, অবিভাবকহীন রাজ্যের বনদফতর। আর তাই জঙ্গলের রাস্তা দিয়ে অবাধে বালি কয়লা, গরু, পাচার হচ্ছে। বালির গাড়ী পারাপারের জন্য জঙ্গলের রাস্তায় লাগানো হাইটবার চুরি করে নিয়েছে। জঙ্গলে মজুত করা হচ্ছে অবৈধ বালি, কয়লা। হয়তো এবার ফরেস্ট অফিসগুলো মাফিয়ারা নিজেদের অফিস তৈরী করে বসবে।
প্রসঙ্গত, ২০২১ সালে দেউলে বিশ্রামাগার উদ্বোধন এসে জঙ্গলের রাস্তায় ভারী যান চলাচল বন্ধে উদ্যোগী হয়েছিলেন, তৎকালীন রাজ্যের বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও তারপর ভারি যান চলাচল বন্ধ হয়। কিন্তু গত মাসখানেক যাবৎ আবারও জঙ্গলের রাস্তায় ভারী যান চলাচলে ক্ষুব্ধ পরেবেশ প্রেমীরা। তাদের অভিযোগ, শীতের মরশুম ছাড়াও সারা বছরই দেউলে পর্যটক আসে। বেহাল রাস্তায় পর্যটকরা বিমুখ হবে। আর প্রশ্ন এখানেই। যে জঙ্গলের সৌন্দর্যকে দেখতে রাজ্য বনদফতর ট্রেকিংয়ের উদ্যোগ নিয়েছে। সেখানে জঙ্গলের ওভারলোডিং বালি বোঝাই লরি ডাম্পার যাতায়াত করে কিভাবে? অভিযোগ বালির লরি যাতায়াতের জন্য জঙ্গলের রাস্তায় হাইটবারগুলি ভেঙে গায়েব করে দিয়েছে বালি পাচারকারীরা। যদিও বন দফতরের মুচিপাড়া রেঞ্জের আধিকারিক সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, বিষয়টি নজরে এসেছে। জঙ্গলের রাস্তায় ভারি যান চলাচল বরদাস্ত করা হবে না। আবারও হাইটবার বসানো হবে। নজরদারি আরও কঠোর করা হবে। প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।
হিন্দুস্থান সমাচার / জয়দেব