দেশের ১২ টি মহানদীকে 'নির্মল ধারা, স্বচ্ছ কিনারা' প্রকল্পে সংস্কারের উদ্যোগ পরিবেশ ও জলশক্তি মন্ত্রকের, দামোদরকে আওতায় আনার আর্জি
দুর্গাপুর, ১৮ সেপ্টেম্বর (হি. স.) যথেচ্ছ প্লাস্টিক, থার্মোকলের ব্যাবহার। তার সঙ্গে শিল্পকারখনার বর্জ
 দুর্গাপুর ব্যারেজ


দুর্গাপুর, ১৮ সেপ্টেম্বর (হি. স.) যথেচ্ছ প্লাস্টিক, থার্মোকলের ব্যাবহার। তার সঙ্গে শিল্পকারখনার বর্জ্য মিশছে নদীতে। ফলে দুষিত হচ্ছে নদী। তার ওপর বালি মাফিয়াদের দৌরাত্মে অবৈধভাবে চলছে বালি উত্তোলন। ফলে ভেঙে পড়ছে নদীর পাড়। বদলে যাচ্ছে নদীর গতিপথ। এবার দেশের ১২ টি মহানদীকে সংস্কার ও দুষণমুক্ত করার উদ্যোগ নিল কেন্দ্রীয় জলশক্তি ও পরিবেশ মন্ত্রক। তার জন্য প্রায় ৪৯ হাজার কোটি টাকার চুড়ান্ত প্রজেক্ট রিপোর্ট তৈরী হয়েছে। রবিবার দুর্গাপুরে এক কর্মসূচীতে এসে এমনটাই জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় বন, আবহাওয়া ও পরিবেশ বিষয়ক (রাষ্ট্র) মন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে। আর ওই প্রজক্টে দামোদর নদের ওপর দুর্গাপুর ব্যারেজের পলি সংস্কার আর্জি জানালেন এক পরিবেশকর্মী।

উল্লেখ্য, রবিবার প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিশ্বকর্মা প্রকল্পে উদ্বোধন করেন। এদিন সারা দেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের দুর্গাপুর, শিলিগুড়ি ও কলকাতাতেও ভার্চুয়াল মাধ্যমে তিনি উদ্বোধন করেন। এদিন দুর্গাপুরের সিআরপিএফ ক্যাম্পে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় বন, আবহাওয়া ও পরিবেশ বিষয়ক (রাষ্ট্র) মন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে। এদিন এক সাক্ষাৎকারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অশ্বীনি চৌবে জানান, দেশের গুরুত্বপুর্ন নদনদীগুলিকে দুষণমুক্ত ও স্বচ্ছ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। নির্মল ধারা, স্বচ্ছ কিনারা। নদনদীগুলিকে সংস্কার করে জল হবে নির্মল ও নদীর পাড়কে মজবুত করা হবে। তারসঙ্গে নদীর পাড়ে সবুজায়ন করা হবে। জলশক্তি মন্ত্রক ও পরিবেশ মন্ত্রক যৌথ উদ্যোগে ৪৯ হাজার কোটি টাকার ডিপিআর তৈরী করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ওই টাকার কাজ হবে। আপাতত দেশের গঙ্গা, যমুনা, সিন্ধু, নর্মদা, কাবেরি, গোদাবরি, বহ্মপুত্র সহ ১২ টি মহানদী প্রথম পর্যায়ে রাখা হয়েছে।

এদিনের অনুষ্ঠানের আগে দুর্গাপুর ব্যারেজের পলি সংস্কার ও দামোদর নদকে 'নির্মল ধারা স্বচ্ছ কিনারা' প্রকল্পে দুষণমুক্ত করার আর্জি জানান পরিবেশকর্মী জয়দেব লাহা। ওই আবেদন জানানো হয়েছে, ১৯৫৫ সালে দামোদর নদের ওপর দুর্গাপুর ব্যারেজটি তৈরী। উদ্দেশ্য ছিল বন্যা নিয়ন্ত্রনের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের প্রসার ও বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলি, হাওড়া জেলার কৃষিকাজে সেচের সুবিধার জন্য। মোট ৩৪ টি লকগেট। ব্যারেজের ক্যাচমেন্ট এরিয়া ১৯.৫৪ বর্গ কিলোমিটার। সর্বাধিক জলের গভীরতা ৬৪. ৪৮ মিটার। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে সংস্কার না হওয়ায় বর্তমানে পলি পড়ে নাবত্যা কমেছে দুর্গাপুর ব্যারেজের। ব্যারেজে ৫ হাজার একর ফুট জলধারন ক্ষমতা। কিন্তু নাবত্যা কমে বর্তমানে জলধারন ক্ষমতা দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৩ হাজার একর ফুটে। আর সেটাই অশনি সঙ্কেত দুর্গাপুরসহ তৎসংলগ্ন শিল্পাঞ্চল ও শস্যগোলা পুর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলি জেলার।

প্রশ্ন, এই অশনির কারন কি?

প্রসঙ্গত, দুর্গাপুর ব্যারেজের ওপর নির্ভরশীল ৮ লক্ষ ২০ হাজার হেক্টর কৃষিজমি। ব্যারেজের মুল সেচখাল দুটি। উত্তর প্রান্তে রয়েছে ১৩৬. ৬ কিমি, দক্ষিণ প্রান্তে রয়েছে ৮৮.৫ কিমি। প্রধান ও শাখা সেচখাল বা ক্যানেল রয়েছে ২৪৯৪ কিমি। উল্লেখ্য, দক্ষিন প্রান্তের সেচক্যানেলে সাইফোনিং সিস্টেম ছিল। তাতে ওই ক্যানেল দিয়ে বর্ষায় যেমন জল ঢুকত ব্যারেজে। তেমনই শীতকালীন চাষে জল ছাড়া হত ওই ক্যানেলে। তবে বর্তমানে ওই সিস্টেম কার্যত অকেজ। কারন গত ১৫ বছর ধরে বর্ষার ধারাবাহিকতা বদলেছে। তার আগে অতিবৃষ্টিপাতের ফলে যেভাবে জল ছাড়া হত। তাতে জলস্রোতের সঙ্গে পলি, নুড়ি, কাঁকর বেরিয়ে পড়ত। কিন্তু সেই বৃষ্টির ধারাবাহিকতা নেই। ফলে, দামোদরের উপরিভাগ থেকে জলস্রোতে পলি, নুড়ি, কাঁকর আসলেও সেসব আটকে পড়ে ব্যারেজে। ফলে জমতে থাকে পলি।

জানা গেছে, দুর্গাপুর ব্যারেজ থেকে আসানসোল- রানীগঞ্জ ও দুর্গাপুরে নগরায়নের জন্য দৈনিক জল লাগে। কৃষিকাজে সেচের জন্য বছরে জল প্রয়োজন সাড়ে ৪ লক্ষ একরফুট। আগামীদিনে যেভাবে নগরায়ন বাড়ছে, তাতে আরও জলের প্রয়োজন। এছাড়াও রয়েছে শিল্পায়ন। আসানসোল-দুর্গাপুর, রানীগঞ্জ, জামুড়িয়া, কাঁকসা, পানাগড় ও বড়াজোড়া শিল্পতালুক ব্যারেজের জলের ওপর নীর্ভরশীল। এছাড়াও রয়েছে ওইসব শিল্পাঞ্চলের মেজিয়া, অন্ডাল, ডিটিপিএস, ডিপিএলসহ ৫ টি গুরুত্বপুর্ন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, যেগুলি ব্যারেজের জল না পেলে মুখ থুবড়ে পড়বে। যদিও ব্যারেজের পলি সংস্কারের জন্য একাধিকবার লোকসভার স্ট্যান্ডিং কমিটি (নদী বিষয়ক) পরিদর্শনে এসেছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।

৯০ দশকে গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যানে দামোদরের পলি সংস্কার ধরা হয়েছিল। এমনকি তাতে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছিল। তার জন্য ক্রেন ও বার্জও আনা হয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা মাঝ পথে ফিরে যায়। ২০০৮ সালে ডিভিসি মাস্টার প্ল্যান তৈরী করেছিল। তাতে ড্রেজিং হওয়া পলি বালি রাখার জমির জন্য আসানসোল-দুর্গাপুর উন্নয়ন পর্ষদের(এডিডিএ) কাছে আবেদন করেছিল। ওইসমস্ত পলি, বালি ইসিএলের পরিত্যাক্ত খনি ভরাটের জন্য চিন্তাভাবনা নেওয়া হয়েছিল। সেটাও মাঝ পথে থমকে যায়। যতদিন যায় ততই সঙ্কটে পড়ে দামোদর। একদিকে যেমন দামোদর উপকুলবর্তী এলাকায় বর্ষায় বৃষ্টিপাত কমতে থাকে। তেমনই জমতে থাকে পলি। আর অন্যদিকে পলি সংস্কার নিয়ে শুরু হয় কেন্দ্র রাজ্য চাপানউতোর। মাঝপথে দুর্ভোগে পড়ে রাজ্যের কৃষকরা।

গত ২০১৭ ও ২০২১ সালে দুর্গাপুর ব্যারেজের লকগেট বিপত্তি ঘটে। হু হু করে বেরিয়ে পড়তে থাকে ব্যারেজের জল। যুদ্ধকালীন তৎপরতায় ব্যারেজের লকগেট সারানোর কাজ শুরু হয়। তবে পলি সংস্কার নিয়ে কোন পরিকল্পনা নজরে পড়েনি। আর পলি সংস্কার না হওয়া জলধারন ক্ষমতা কমে যাওয়া বরো চাষের মরশুমে পর্যাপ্ত জল পায়নি চাষীরা। এমনকি কম বৃষ্টিপাতের দরুন চলতি খারিফ মরশুমেও কম জল পেয়েছে চাষীরা। তার সঙ্গে গোটা শিল্পাঞ্চল আতঙ্কে ভুগছে। আশঙ্কা আগামীদিনে জলসঙ্কটের পড়তে হবে শিল্পশহরবাসীকে।

পরিবেশকর্মীরা আবেদনে জানিয়েছেন, দুর্গাপুর ব্যারেজে পলি সংস্কার আবশ্যিক। সংস্কার হওয়া পলি, বালি ইসিএলের পরিত্যাক্ত খনিতে ভরাট করা যেতে পারে। জলসঙ্কট মোকাবিলায় বিকল্প ব্যারেজ করা দরকার। দামোদরের ২০ কিলোমিটার নিম্নে রনডিহা 'ওয়ের' বা ছোট জলাধার। সেটাও পলি জমে ভরাট হয়েছে। তারও দুপাশে দুই স্বল্প দৈর্ঘ্যের সেচখাল বা ক্যানেল মজে গেছে পলিতে।

তাই, রনডিহায় ওই জলাধারটিকে বিকল্প ব্যারেজ তৈরী করা দরকার। তাতে যেমন বর্ষায় অতিরিক্ত জল ধরে রাখা যাবে। জলসঙ্কট আগামীদিনে মোকাবিলা করা যাবে। পানাগড়, কাঁকসা শিল্পতালুকে জলের জোগান দেওয়া যাবে। পাশাপাশি, বর্ধমান, বাঁকুড়া, হুগলি জেলায় কৃষিকাজে সেচের জলের জোগান দেওয়া সহজ সম্ভব হবে। প্রায় ৫ লক্ষ হেক্টর কৃষিজমি সুবিধা সেচের সুবিধা পাবে।

এছাড়াও দামোদরের দুর্গাপুর ও রনডিহা জলাধার দুটির প্রায় ২৫ কিমি উত্তরে অজয় নদ। বর্ষায় প্লাবিত হয় অজয়। কখনও কখনও ফুলে ওঠে বর্ষার জলে। ওই জল ধরে রাখার জন্য বাঁধ নির্মাণ করা দরকার। তাতে যেমন বন্যা নিয়ন্ত্রণ হবে। তেমনই দুই বর্ধমান, বীরভুম জেলায় কৃষিকাজে সেচের সুবিধা হবে। অজয় ও দামোদর নদীর সংযোগ করা দরকার। তাতে অজয়ে প্লাবিত জলরাশি সংযোজিত সেচখালের মাধ্যমে দুর্গাপুর কিম্বা রনডিহা জলাধারে রাখা যেতে পারে। তাতে প্লাবনের জল আটকানো যাবে। তেমনই ওই জল রনডিহা থেকে পানাগড় শিল্পতালুকে জলের জোগান দেবে। এবং পরিশোধিত করে পানাগড়, কাঁকসা, বুদবুদ, গলসী, আউশগ্রামে পানীয় জল পরিষেবা দেওয়া সুবিধা হবে। উপকৃত হবে ২০ লক্ষ হেক্টরেরও বেশী কৃষি জমি।

দামোদরের পলি সংস্কারের বিষয়ে কেন্দ্রীয় বন, আবহাওয়া ও পরিবেশ বিষয়ক (রাষ্ট্র) মন্ত্রী অশ্বিনী চৌবে জানান, আবেদন পেয়েছি। দুষণের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে। খুব শীঘ্রই বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধ দল পাঠানো হবে। বাকি বিষয়গুলি জলশক্তি মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।

হিন্দুস্থান সমাচার / জয়দেব




 

 rajesh pande