ব্যাপক ভাঙন ওপার বাংলাতেও, উজানে ভাঙন শুরু হওয়ায় ফের বস্তা ফেলা শুরু কুড়িগ্রামে
কুড়িগ্রাম, ৭ অক্টোবর (হি.স.): নদীর ভাঙনের তীব্রতায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী অন্তত ৩০টি পরিবার বাস্তুহারা, নিঃস্ব। তাঁরা কোথায় যাবেন, পরিবার নিয়ে কীভাবে বসতি গড়বেন, সে চিন্তায় দিশাহারা। এখনও ভাঙন হুমকিতে দাঁড়িয়ে আছে
ব্যাপক ভাঙন ওপার বাংলাতেও, উজানে ভাঙন শুরু হওয়ায় ফের বস্তা ফেলা শুরু কুড়িগ্রামে


কুড়িগ্রাম, ৭ অক্টোবর (হি.স.): নদীর ভাঙনের তীব্রতায় বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী অন্তত ৩০টি পরিবার বাস্তুহারা, নিঃস্ব। তাঁরা কোথায় যাবেন, পরিবার নিয়ে কীভাবে বসতি গড়বেন, সে চিন্তায় দিশাহারা। এখনও ভাঙন হুমকিতে দাঁড়িয়ে আছে আরও অর্ধশতাধিক পরিবার। মূল ভাঙন হয়েছে কুড়িগ্রাম সদরের দুধকুমার নদের।।

সোমবার দিনভর যাত্রাপুর ইউনিয়নের বানিয়াপাড়া গ্রামে এই ভাঙন হয়। মঙ্গলবারও ভাঙন চলছে। হঠাৎ শুরু হওয়া ভাঙনে ডান তীরের মাটি নদের জলে আছড়ে পড়ার শব্দে রবিবার মধ্যরাত থেকে ঘুম ভাঙে গ্রামবাসীদের। ততক্ষণে সব কিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে। রান্নাঘর, টিউবওয়েল, বাড়ির সীমানাপ্রাচীর আবার কারও বা ভিটার অংশ নদের গর্ভে যেতে শুরু করে।

জীবন বাজি রেখে রাতের অন্ধকারে নারী-পুরুষ সবাই মিলে বসতঘর ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরানোর কাজ শুরু করেন। দিনের আলো ফুটতেই ভাঙনের তীব্রতার সঙ্গে দুর্গতদের কর্মযজ্ঞ বাড়ে। ঘর ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরিয়ে নিতে এগিয়ে আসেন গ্রামবাসী ও স্বজনরা।

দুধকুমারের ক্ষুরধার স্রোতের তোড়ে যত্নে গড়া বসতির এভাবে বিলীন হওয়ার দৃশ্য হাহাকার নিয়ে দেখছেন বাসিন্দারা। সতর্কতার জন্য বালু ভর্তি কয়েকশো ‘জিও ব্যাগ’ ফেলা হয়েছিল ওই অঞ্চলে। অভিযোগ সেগুলো যথাস্থানে ফেলা হয়নি। খানিকটা ভাটিতে থাকা বস্তাগুলোকে দেখে ক্ষতিগ্রস্তদের হাহাকার যেন বাড়িয়ে দেয়। তাঁদের অভিযোগ, ‘সঠিক স্থানে’ বস্তুাগুলো ফেললে হয়তো এমন পরিণতি হতো না!

ভাঙন প্রতিরোধে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতির প্রশ্নে কিছুটা সাফাই গেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বলেন, ‘তারা (পাউবো) বলেছে ভাটির দিকে ভাঙন ছিল বলে সেখানে বস্তা ফেলা হয়েছে। এছাড়া তাদের শ্রমিক সংকট ছিল।

দুধকুমারের আকস্মিক আগ্রাসী রূপের বর্ণনা করে নিজেদের দুর্গতি আর ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার কথা বলছিলেন ভাঙনের শিকার বাসিন্দা তাইজুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আগেও ভাঙছে। কিন্তু এমন ছিল না। এমনভাবে ভাঙছে মনে হয় সউগ ক্যালে (ছিনিয়ে) নিয়া গেইছে। এক রাইতে অন্তত দুইশ গজের বেশি জায়গা খাইছে। আমরা তো ভাঙনের জন্য প্রস্তুত নই। যেহেতু চরে থাকি সেহেতু ভাঙনের আগেভাগে বুঝতে পারি। একদিনে আর কতদূর ভাঙবে! কিন্তু এমনভাবে ভাঙছে যে সব শ্যাষ করি দিছে,’ যোগ করেন তাইজুল।

তাইজুলের স্ত্রী নাজমা বলেন, ‘রাইত থাকি ভাঙতেছে। সউগ শ্যাষ। এলা ছাওয়া পাওয়া ধরি কোটাই থাকমো।’ কেবল তাইজুল বা তার স্ত্রী নাজমা নন, এমন প্রশ্ন বানিয়াপাড়া গ্রামের ভাঙন কবলিত সব পরিবারে। পরিবার নিয়ে ভবিষ্যৎ বসতি, সন্তানদের লেখাপড়া আর জীবন জীবিকার চিন্তায় দিশাহারা তারা।

গ্রামটির বাসিন্দা গৃহবধূ মনছনা বেগম। অসুস্থ মাকে দেখতে গিয়েছিলেন বাবার বাড়ি। রাতেই খবর পান বাড়ি ভাঙছে। সকাল হতেই বাড়ি ফিরে দেখেন সব শেষ। তারা পৌঁছনোর আগেই বাড়ির সীমানা প্রাচীর, টিউবওয়েলসহ বসতভিটার অনেকটাই নদে বিলীন হয়েছে। দিনভর বাড়িঘর ভেঙে পুরো সংসার তুলে দেন বাবার বাড়ি থেকে আসা নৌকায়। সাথে দুই ছেলেকেও। উদ্দেশ্য চর নারায়নপুর।

বাস্তুহারা মনছনা মুখে কাপড় গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘জায়গা নাই। কোথায় যাবো? সব ভেঙে ভাইয়ের বাড়ি নারায়ণপুরে পাঠালাম। এখানে ছিলাম বাচ্চাদের লেখাপড়া করাইছি। ছেলেদের লেখাপড়া সব শেষ হয়া গেলো। ওখানেতো পাড়ালেখা করাইতে পারবো না,’ বলেই কাঁদতে থাকেন। তাঁর স্বামী ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। দু’মাস ধরে তার কাজ নাই। বেতন বন্ধ। ভবিষ্যৎ কী হবে জানা নেই তার। মনছনার পরিবারের মতো বাড়িঘর ভেঙে সবকিছু নিয়ে এলাকা ছাড়েন হাফিজুর ও তার পরিবার।

একটি নৌকায় ভেঙে নেওয়া ঘরের জিনিসপত্রসহ বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানকে তুলে দিয়ে আরেক চরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন হাফিজুর। সেখানে গিয়ে বসতি গড়ে কত বছর স্থায়ী হবেন তা জানা নেই তার। অনিশ্চিত দিনের যাত্রায় ভাঙন কবলিত অন্যসব পরিবারগুলো।

দুধকুমার তীরে দুশ’ গজ দূরত্বে ভাঙনের আশঙ্কায় থাকা সত্তরোর্ধ্ব মজিবর রহমান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘সব চোর-চারটার দল। যেখানে বস্তা ফেলা দরকার সেখানে ফেলে না। ঠিক মতো কাজ করলে এমন ক্ষতি হইতো না। ছয় বার বাড়ি ভাঙছে। এবারও থাকবে না।’

ভাঙন এলাকায় গিয়েছেন সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. ইসমাইল হোসেন। তিনি ভাঙন কবলিত পরিবারের তালিকা প্রস্তুত করে তাদেরকে মানবিক সহায়তার আশ্বাস দেন। একই সাথে ভাঙন প্রতিরোধে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাসও দেন ইউএনও। তবে ভাঙনের শিকার পরিবারগুলোর পুনর্বাসনে তাৎক্ষণিক কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানাতে পারেননি তিনি।

---------------

হিন্দুস্থান সমাচার / মৌসুমী সেনগুপ্ত




 

 rajesh pande