আসামের এসটিএফ ও ত্রিপুরা পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার যৌথ অভিযানে অসম ও ত্ৰিপুরা থেকে ধৃত ১১ জন জিহাদি
গুয়াহাটি, ৩০ ডিসেম্বর (হি.স.) : ভারতের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি অসম এবং উত্তরপূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সক্রিয় একটি বিস্তৃত জিহাদি নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত নজরদারির পর এই জিহাদি তৎপরতার বিষয়টি ধরা পড়েছে। আজ
গুয়াহাটির পুলিশ কমিশনার তথা আসাম পুলিশের এসটিএফ-প্রধান ড. পার্থসারথি মহন্ত


গুয়াহাটি, ৩০ ডিসেম্বর (হি.স.) : ভারতের নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলি অসম এবং উত্তরপূর্ব ভারতের অন্যান্য রাজ্যের সক্রিয় একটি বিস্তৃত জিহাদি নেটওয়ার্কের সন্ধান পেয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পরিচালিত নজরদারির পর এই জিহাদি তৎপরতার বিষয়টি ধরা পড়েছে।

আজ গুয়াহাটিতে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ বিষয়ে তথ্য সংবলিত বক্তব্য পেশ করছিলেন গুয়াহাটির পুলিশ কমিশনার তথা আসাম পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ)-এর প্রধান ড. পার্থসারথি মহন্ত। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলির পেশকৃত নির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে স্পেশাল টাস্ক ফোর্স বাংলাদেশ-ভিত্তিক এক জঙ্গি মডিউল ‘ইমাম মাহমুদার কাফিলা’ সংক্ষেপে আইএমকে-র কার্যকলাপ চিহ্নিত করেছে। এই সংগঠনের সক্রিয় সেল রয়েছে অসম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গে।

এসটিএফ-প্রধান ড. মহন্ত জানান, বাংলাদেশ-ভিত্তিক মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলির সাথে কথিত সংযোগ লক্ষ্য করে গোয়েন্দা অভিযানের পর পুলিশ অসম ও ত্রিপুরায় অভিযান চালিয়ে ১১ জনকে গ্রেফতার করেছে। গতকাল রাতে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলার পার্শ্ববর্তী এক গ্রামের পাশাপাশি অসমের বরপেটা, চিরাং এবং দরং জেলায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

ড. মহন্ত জানান, অসম থেকে ১০ এবং ত্রিপুরা থেকে একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তিনি জানান, এই দলের সদস্যরা বাংলাদেশে অবস্থিত হ্যান্ডলারদের নির্দেশে কাজ করছিল এবং ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন কে নামের একটি নবগঠিত সংগঠনের অংশ ছিল।

তাদের মূল লক্ষ্য ছিল, অসম সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাকি অংশকে অস্থিতিশীল করা, বলেন এসটিএফ-প্রধান মহন্ত। তিনি বলেন, জিহাদি এই দলকে এতদঞ্চলে মুসলিম আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে নিয়োগ করা হয়েছিল।

তিনি জানান, অতিরিক্ত লিঙ্ক, তহবিল চ্যানেল এবং সম্ভাব্য স্লিপার মডিউলগুলি শনাক্ত করতে শীর্ষ স্তরে তদন্ত চলছে। ড. মহন্ত বলেন, ‘ইমাম মাহমুদার কাফিলা’ নিষিদ্ধ সংগঠন জামাত-উল-মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর একটি শাখা। এই সংগঠনটি ২০১৮ সালে জুয়েল মাহমুদ ওরফে ইমাম মাহমুদ হাবিবুল্লাহ বা সোহেলের হাতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি জেএমবি-র প্রাক্তন সদস্য এবং নিজেকে ‘ইমাম মাহমুদার কাফিলা’-র ‘আমির’ হিসেবে পরিচয় দেন। এই সংগঠনটি ‘গজওয়াতুল হিন্দ’ মতাদর্শ প্রচার করে এবং আন্তর্জাতিক জিহাদি সংগঠনগুলির সঙ্গে আদর্শগতভাবে সংযুক্ত।

এসটিএফ-প্রধান পার্থসারথি মহন্ত বলেন, বাংলাদেশে ২০২৪ সালের আগস্টে সরকার পরিবর্তনের পর গোয়েন্দা সংস্থাগুলি জানতে পেরেছে, জামাত-উল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) এবং আল-কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট (একিউআইএস)-এর শীর্ষ নেতারা ‘ইমাম মাহমুদার কাফিলা’-র নেতৃত্বকে ভারতে তাদের মডিউল সক্রিয় ও সম্প্রসারণের নির্দেশ দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে উমর ও খালিদ নামে দুই বাংলাদেশি নাগরিককে অসমে কার্যকলাপ সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়, যেখানে স্থানীয় সেলের নেতৃত্বে ছিল বরপেটা রোডের বাসিন্দা নাসিম উদ্দিন ওরফে তামিম।

পুলিশ ও গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন ‘ইমাম মাহমুদার কাফিলা’ এনক্রিপ্টেড ও সুরক্ষিত সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে তাদের কার্যকলাপ পরিচালনা করত। ‘পূর্ব আকাশ’ নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ ডিজিটাল গ্রুপ তাদের প্রধান যোগাযোগ, নিয়োগ ও উগ্রবাদী চিন্তাধারা ছড়ানোর প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করত। এই চ্যানেলের মাধ্যমে অসম, পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরার ব্যক্তিদের উগ্রবাদে প্রভাবিত করা, নিয়োগ এবং আর্থিকভাবে সংগঠিত করা হতো। এর মধ্যে বাংলাদেশে যাতায়াতকারী ভারতীয় পাসপোর্টধারী এবং নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনের প্রাক্তন সদস্যরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল, বলেন ড. মহন্ত।

তিনি আরও জানান, ‘ইমাম মাহমুদার কাফিলা’ নিজেকে ‘গাজওয়াতুল হিন্দ’-কেন্দ্রিক একটি চরমপন্থী মডিউল হিসেবে উপস্থাপন করে এবং ভারতের বিরুদ্ধে সশস্ত্র দখলদারির পক্ষে সহিংস জিহাদি প্রচার চালায়। গোয়েন্দা তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে এসটিএফ-প্রধান বলেন, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর জেএমবি, এবিটি ও একিউআইএস-এর ক্যাডাররা মুক্তি পেয়ে আরও উৎসাহিত হয়েছে। যার ফলে তাদের আদর্শিক প্রভাব ও ভারতীয় নেটওয়ার্ক ‘ইমাম মাহমুদার কাফিলা’-র সঙ্গে যুক্ত নেটওয়ার্ক সহ পুনরুজ্জীবিত হয়।

‘ইমাম মাহমুদার কাফিলা’ নেতৃত্বের রচিত চরমপন্থী সাহিত্য, যেমন ‘সার্বভৌম খামতার মালিক আল্লাহ’ এবং ‘গাজওয়াতুল হিন্দ-এর সংক্ষিপ্ত আলোচনা’, অনলাইনে পরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিয়ে নতুন সদস্য ও সমর্থকদের মধ্যে উগ্রবাদী মতাদর্শ গেঁথে দেওয়া হতো। অসমে এ সমস্ত বিষয়বস্তু এনক্রিপ্টেড ‘পূর্ব আকাশ’ গ্রুপের মধ্যেই ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হয়।

নিরাপত্তা সংস্থাগুলির প্রদত্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে তিনি জানান, ‘ইমাম মাহমুদার কাফিলা’ একটি সুসংগঠিত ও গোপন নিয়োগ প্রক্রিয়া অনুসরণ করত। সম্ভাব্য সদস্যদের প্রথমে অনলাইন জিহাদি চ্যানেলের মাধ্যমে চিহ্নিত করা হতো এবং ধাপে ধাপে আইএমকে-র প্রচারসামগ্রীর মাধ্যমে তাদের মতাদর্শে দীক্ষিত করা হতো। সংগঠনে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিতে হলে নিয়োগপ্রার্থীদের আইএমকে-র আমির মাহমুদ হাবিবুল্লাহর প্রতি ‘বাইয়াত’ বা আনুগত্যের শপথ নিতে হতো।

এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিগত তথ্য ও পরিচয়পত্র জমা দেওয়া এবং শপথ গ্রহণের একটি ভিডিও রেকর্ড করা হতো, যা প্রথমে একজন ভারতীয় ‘জিম্মাদার’-এর কাছে পাঠানো হতো এবং সেখান থেকে যাচাইয়ের জন্য বাংলাদেশে আমিরের কাছে পাঠানো হতো। যাচাই সম্পন্ন হওয়ার পরই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করা হতো। নিরাপত্তা সূত্রের ধারণা, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অসমের বরপেটা ও চিরাং জেলা, পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের কিছু অংশে একাধিক যুবক উগ্রপন্থায় প্রভাবিত হয়েছে।

ড. মহন্ত জানান, ‘ইমাম মাহমুদার কাফিলা’ বা আইএমকে স্থানীয় সামাজিক ও ধর্মীয় সমাবেশকেও নিয়োগের কাজে ব্যবহার করত। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তিনি জানান, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে স্থানীয় মসজিদগুলিতে একাধিক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। এমনই এক বৈঠক ২০২৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর বরপেটায় অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে আইএমকে-র মতাদর্শীগণ, নাসিম উদ্দিন ও মণিরুল ইসলাম সহ অনেকে উসকানিমূলক ভাষণ দেন এবং ভারতে সশস্ত্র সহিংস সংগ্রামের পক্ষে বক্তব্য পেশ করেছেন। ওই বৈঠকে উসকানি দিয়ে বলা হয়েছিল, ‘ভারতে মুসলমানদের ওপর সংগঠিত অত্যাচার সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বন্ধ করতে হবে।’

ওই বৈঠকগুলো সাধারণত ছয় থেকে আটজন স্থানীয় যুবককে নিয়ে অনুষ্ঠিত হতো, যাদের জিহাদের জন্য প্রস্তুত হতে আহ্বান জানানো হতো। কিছু নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি বৈধ পাসপোর্ট ও ভিসায় বাংলাদেশে গিয়ে আইএমকে-র শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বলে জানান এসটিএফ-প্ৰধান। তিনি জানান, আবার অন্যদের পরিবার সহ সেখানে গিয়ে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য উৎসাহিত করা হয়। উল্লেখযোগ্যভাবে, অন্তত দু-জন অসম-ভিত্তিক অপারেটিভ ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে বাংলাদেশি হ্যান্ডলারদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য মেঘালয়ে প্রবেশ করে।

তদন্তে আরও জানা গেছে, আইএমকে-র অর্থায়নের পদ্ধতিতে হাওয়ালা নেটওয়ার্ক ও ক্ষুদ্র অঙ্কের ব্যাংক লেনদেন অন্তর্ভুক্ত ছিল। অসমে নিয়োগপ্রাপ্ত সদস্য ও সমর্থকদের কাছ থেকে সংগৃহীত নগদ অনুদান নাসিম উদ্দিন একত্রিত করত এবং তা হাওয়ালা চ্যানেল ও একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশে পাঠানো হতো। অভিযুক্তরা ইউপিআই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেও অর্থ স্থানান্তর করত বলে জানান তিনি।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অনুমান, চরমপন্থী প্রশিক্ষণ ও লজিস্টিক সহায়তার জন্য অসম ও ত্রিপুরা থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে, যার মাধ্যমে একাধিক ব্যক্তি সন্ত্রাসে অর্থায়নের সঙ্গে জড়িত বলে চিহ্নিত হয়েছে।

২০২৪ সালে বাংলাদেশে হাসিনা সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আইএমকে-র সীমান্তপারের সমন্বয় আরও জোরদার হয়। ওই সময় সংগঠনটির আমিরকে হেফাজত থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল বলেও রিপোর্ট রয়েছে। সংস্থাগুলি লক্ষ্য করেছে, আইএমকে সক্রিয়ভাবে ‘হিজরত’ বা বাংলাদেশে অভিবাসনের ধারণা প্রচার করছিল এবং সীমান্তের ওপারে অবস্থানকারী হ্যান্ডলারদের সঙ্গে প্রশিক্ষণ ও আদর্শগত যোগাযোগ বজায় রেখেছিল। অসমে প্রচারিত অস্ত্র ও বোমা তৈরির বিষয়ক চরমপন্থী উপকরণ বাংলাদেশে আগে উদ্ধারকৃত আইএমকে-সংযুক্ত উপকরণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সাদৃশ্যপূর্ণ বলে পাওয়া গেছে, যা দীর্ঘস্থায়ী সীমান্তপারের সহযোগিতার প্রমাণ, জানান ড. পার্থসারথি মহন্ত।

তিনি জানান, এই কার্যকলাপকে ভারতের সার্বভৌমত্ব, ঐক্য ও জনশৃঙ্খলার জন্য গুরুতর হুমকি বলে নিরাপত্তা সংস্থাগুলি সমন্বিত পাল্টা অভিযান শুরু করে। চলতি ২০২৫ সালের ২৯ এবং ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যবর্তী রাতে অসম পুলিশ স্পেশাল টাস্ক ফোর্স অসমের বরপেটা, চিরাং, বাকসা ও দরং জেলার একাধিক স্থানে, পাশাপাশি ত্রিপুরায়ও একযোগে অভিযান চালায়। অভিযানে মোট ১১ জন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বরপেটা রোডের নাসিম উদ্দিন ওরফে তামিম। সে অসম মডিউলের প্রধান হিসেবে চিহ্নিত, পাশাপাশি অসম ও পশ্চিম ত্রিপুরার অন্যান্য অপারেটিভরাও ধরা পড়ে।

এসটিএফ-প্রধান জানিয়েছেন, এই গ্রেফতারগুলি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে আইএমকে নেটওয়ার্ক ভাঙার ক্ষেত্রে একটি বড় সাফল্য। তবে তদন্ত এখনও চলছে এবং সীমান্তপারের জিহাদি সংগঠনগুলির সঙ্গে যুক্ত আরও সংযোগ, আর্থিক লেনদেনের সূত্র ও স্লিপার সেল চিহ্নিত করার কাজ অব্যাহত রয়েছে।

হিন্দুস্থান সমাচার / সমীপ কুমার দাস




 

 rajesh pande