
দুর্গাপুর, ৬ ডিসেম্বর (হি. স.) : -আর্থ সামাজিক উন্নয়ন করতে গিয়ে কলকারখানার দূষণে জেরবার শিল্পশহর। কোটি টাকার মেশিন কিনেও দূষণমুক্তির দিশা কার্যত অধরা। বিদ্যুত বিলের জেরে কারখাায় ইএসপি চালানো হয় না বলে অভিযোগ। আর তাতেই লাগামহীন দূষণে ওষ্ঠাগত প্রান অন্ডাল, পান্ডবেশ্বর, পানাগড়, দুর্গাপুর শিল্পশহরের বাসিন্দাদের। দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদের ভূমিকায় উদ্বিগ্ন শহরবাসী। বায়ুদূষণে রাজধানী দিল্লীকে টেক্কা দিল দুর্গাপুর, অন্ডাল-পান্ডবেশ্বর।
প্রসঙ্গত, গত কয়েকবছর ধরে দুর্গাপুর শহরে মাত্রাতিরিক্ত বায়ু দূষণে জেরবার শহরবাসী। কখনও কখনও কেন্দ্রীয় পরিবেশ দফতরের তালিকায় বায়ু দূষণে দিল্লির পরই দুর্গাপুরের নাম উঠে এসেছে। বিশেষত রাতুড়িয়া, অঙ্গদপুর সগড়ভাঙা বাঁশকোপা, বামুনাড়া, পানাগড় এলাকায় বাতাসে ধূলিকনা ও কারখানার কালো ছাইয়ে নাকাল শহরবাসী।
বিজ্ঞনীমহল সূত্রে জানা গেছে, Pm.-2.5 ও Pm.10 র মতো উপাদানগুলি ৬০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি মিটারকিউবে থাকা স্বাভাবিক মানা হয়। শনিবার দিল্লির হরিনগরে এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স অর্থাৎ বায়ুর গুনমান সূচক ১৮৬, PM10- ১২৬, PM2.5- ১০৫, আনন্দ বিহারে গুনমাননসূচক ২১৮, PM10- ১৯৯, PM2.5- ১৪৩। এদিকে শনিবার সকাল ৯ টায় দুর্গাপুরে বায়ুর গুনমান সূচক ছিল ১৭৫, Pm-10 প্রতি মিটারকিউবে ১৬৯ মাইক্রোগ্রাম রয়েছে। Pm-2.5 ছিল ৯০ মাইক্রোগ্রাম প্রতি মিটার কিউবে। আবার দুর্গাপুর পিসিবিএল, রাতুড়িয়া অঙ্গদপুর, কিম্বা বামুনাড়া, বাঁশকোপা শিল্পতালুকে আরও একটু বেশী রয়েছে। যা স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশী। আবার অন্ডাল ও পান্ডবেশ্বরে বায়ুর গুনমান সূচক মনিটারিং স্টেশন না থাকলেও তুলনামূলকভাবে অনেকটাই বেশি বলে দাবী করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। বায়ুর গুনমান সূচক বৃদ্ধিতে উদ্বিগ্ন শিল্পাঞ্চলবাসী। অন্ডালে ডিভিসির ছাই বাতাসে মেশায় আতঙ্কের কারন হয়ে উঠেছে। আবার পান্ডবেশ্বর বাজার ও তৎসংলগ্ন এলাকায় কারখানার ছাইয়ে বাতাসে ধূলিকণা মাত্রাতিরিক্ত বেড়েছে। বাতাসে গুনমান সূচক বৃদ্ধিতে দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদের উদাসীনতাকে দুষছে এলাকাবাসী। বাসিন্দাদের অভিযোগ খনি অঞ্চলে রাস্তার ভারি যান চলাচলের ফলে ধূলিকণা বেড়েছে। তার ওপর ভাঙাচোরা রাস্তার দরুন বাতাসে ধূলিকণা বাড়ছে। সেগুলো শরীরের ফুসফুসে গিয়ে ক্ষতি করে। হাঁপনি, অ্যাজমার মতো রোগ হয়। আর এই মাত্রাতিরিক্ত দূষণে উদ্বিগ্ন গোটা শিল্পশহরবাসী। ওয়ার্ল্ড হেল্থ ওর্গানাইজেশনের (WHO) দাবী, AQI ১৫১-২০০ এর মধ্যে বায়ুর গুণমানকে 'অস্বাস্থ্যকর এবং স্বাস্থ্যের ঝুঁকি' হিসেবে চিহ্নিত করে। মঙ্গলবার দুর্গাপুরের বায়ুর গুনমান সূচক WHO দাবী অনুযায়ী যা খুবই তীব্র এবং অস্বাস্থ্যকর ও ক্ষতিকর। এবং সবচেয়ে বেশী উদ্বেগজনক রয়েছে অন্ডাল- পান্ডবেশ্বরে অতি তীব্র, অস্বাস্থ্যকর ও খুবই ক্ষতিকর। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, দিনে প্রায় ১৫ থেকে ২০ টি সিগারেট বিনামূল্যে ধূমপানের সমতুল্য যা শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, হাঁপানি, তীব্রতা এবং কার্ডিওভাসকুলার স্ট্রেসের ঝুঁকি বাড়ায়।
উল্লেখ্য, গত বছর দুর্গাপুরের বাতাসে মাত্রারিক্ত বায়ুদূষণ বেড়ে যাওয়া, শহরে ছুটে আসেন খোদ রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রন অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (ওএসডি) সুব্রত ঘোষ। তিনি সাফাই দেন শীতকালে উত্তুরে হাওয়া দক্ষিণে আসার ফলে ঝাড়খণ্ডের দূষণ ঢুকছে বাংলায়। তাই সীমান্তবর্তী জায়গা ত্রিস্তরিয় সবুজায়ন করা দরকার। দুর্গাপুরের পরিবেশ কর্মী কবি ঘোষ বলেন, দুর্গাপুরে দূষণ বেড়েছে। আমরা উদ্বিগ্ন। প্লাস্টিকের ব্যাবহার কমাতে হবে। তার জন্য রাজ্য ও কেন্দ্র উভয় সরকারকে সজাগ দৃষ্টি আকর্ষন করছি। দূষণ রোধে সমস্ত সেচ্ছাসেবী সংগঠন মিলে সবুজের অভিযান সংগঠিত করা হচ্ছে। আমরা দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদে অভিযোগ জানিয়েছি। গত ২ ডিসেম্বর দুর্গাপুর দূষণ নিয়ন্ত্রন পর্ষদ দুর্গাপুর নগর নিগমকে বেশ কয়েকটি বিষয়ে ইতিমধ্যে সতর্ক করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে, বর্জ্য জমা কমাতে এবং খোলা জায়গায় পোড়ানোর প্রয়োজনীয়তা দূর করতে এমআরএফ প্রতিষ্ঠা করা দরকার। দ্বিতীয়ত, পরিবেশগত নিয়মাবলীর প্রয়োগ জোরদার করা, বিশেষ করে শিল্প ও নির্মাণ খাতে। তৃতীয়ত, নাগরিক সচেতনতামূলক প্রচারণার মাধ্যমে খোলা জায়গায় বর্জ্য পোড়ানোর উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন ও তদারকি করা। চতুর্থত, দুর্গাপুর জুড়ে অতিরিক্ত কন্টিনিউয়েস অ্যাম্বিয়েন্ট এয়ার কোয়ালিটি মনিটরিং স্টেশন (CAAQMS) সহ বায়ুর মান পর্যবেক্ষণ পরিকাঠামো উন্নত করা। আর প্রশ্ন এখানেই।
অভিযোগ, পান্ডবেশ্বর, লাউদোহায় দুর্গাপুর সগড়ভাঙা, পিসিবিএল, রাতুড়িয়া, অঙ্গদপুর, কাঁকসা বাঁশকোপা, বামুনাড়া শিল্পতালুকে রয়েছে নানান ফেরো অ্যালোয়ের মত কারখানা। অভিযোগ এসমস্ত কারখানাগুলিতে ব্যায়ভারের কারনে ইএসপি মেশিন চালায় না। ফলে বাতাসে দূষণ মাত্রা লাগামছাড়া বৃদ্ধি পায়। তার ওপর শিল্পতালুকের বেহাল রাস্তার দরুন বাতাসে ধুলিকনা বৃদ্ধি পায়। বছর কয়েক আগে ঢাকঢোল পিটিয়ে বাতাসে ওই ধূলিকনা কমানোর জন্য একগুচ্ছ উদ্যোগ নেয় স্থানীয় দুর্গাপুর পুরসভা। সেই মত রাস্তার ধূ!লোবালি ঠেকানোর জন্য সকাল বিকাল স্প্রিংলার ওয়াটার সিস্টেম কাজে লাগানো। এছাড়াও মিস্ট ক্যানন মেশিন, যেটি বায়ু দূষণ এলাকায় কৃত্রিম উপায় বৃষ্টি করানো হয়। বছর দুয়েক আগে প্রায় ৫০ লক্ষ টাকা ব্যায়ে মিস্ট ক্যানন, ৫১ লক্ষ টাকা ব্যায়ে রোড সুইপার ও ২৯ লক্ষ টাকা ব্যায়ে স্প্রিঙ্কলার ওয়াটার সিস্টেম কেনা হয় দুর্গাপুর নগর নিগমে। যদিও সেসব কখন কোথায় ব্যাবহার হয়, সেসব প্রশ্ন রয়েছে।
আর প্রশ্ন এখানেই, তাহলে কি বাতাসের দূষণ নিয়ন্ত্রন কি দিশাহীন? কেনই বা কোটি টাকার মেশিন পত্তর ব্যাবহার হয় না? বিজেপি নেতা শ্রীদিপ চক্রবর্তী বলেন, দুর্গাপুর, অন্ডাল ও পান্ডবেশ্বরে যেভাবে বায়ুর গুনমান সূচক বেড়েছে, তাতে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন এলাকাবাসী। অন্ডাল, পান্ডবেশ্বর, পানাগড়ে দূষণ পরিমাপক ষ্টেশন বসানো দরকার। দুর্গাপুর শহরে দূষণ পরিমাপক ষ্টেশনগুলি আরও উন্নত ও আপগ্রেড করা দরকার। শহরের রাস্তায় স্থানীয় প্রশাসন কিম্বা কারখানাগুলি থেকে কখনই জল ছড়ানো হয় না। এক কথায় দূষণ নিয়ন্ত্রন লাটে উঠেছে। যদিও দুর্গাপুর নগর নিগমের ভাইস চেয়ারপার্সন ধর্মেন্দ্র যাদব বলেন, নিয়মিত মনিটারিং করা হয়। স্প্রিংকলার দিয়ে জল ছড়ানো হয় নিয়মিত। তবে দুর্গাপুর পরিবেশ দফতরের আধিকারিক অরূপ দে বলেন, শীতকালে বায়ু দূষণ বেশী হয়। নিয়মিত মনিটারিং করা হয়।
হিন্দুস্থান সমাচার / জয়দেব লাহা