
শিলিগুড়ি, ৩ ডিসেম্বর (হি.স.) : উত্তরবঙ্গের অবহেলা ও উন্নয়নে বাধা এবং বিভিন্ন পরিকাঠামোগত ব্যর্থতা নিয়ে কটাক্ষ করলেন ফালাকাটার বিধায়ক ও দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক দীপক বর্মন।
শিলিগুড়ি জার্নালিস্ট ক্লাবে বুধবার সাংবাদিক সম্মেলনে তাঁরা উত্তরবঙ্গের সার্বিক অবহেলা, পরিকাঠামো আর সমস্যা এবং বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পে রাজ্য সরকারের বাধা সৃষ্টি নিয়ে অভিযোগ করেন।
শুরুতেই শঙ্করবাবু জানান, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা ও উন্নয়ন নিয়ে যেসব বিভ্রান্তিকর তথ্য মানুষের সামনে রাখেন তা আজ তথ্যভিত্তিকভাবে খণ্ডন করা হচ্ছে। এরপর মূল বক্তব্য রাখেন দীপক বর্মন।
দীপকবাবু বলেন, ভৌগোলিক দিক থেকে উত্তরবঙ্গ পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ১৮ শতাংশ জমি এবং প্রায় ১৮ শতাংশ জনসংখ্যা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষে রাজ্যের ৩.৭ লক্ষ কোটি টাকার বাজেটে উত্তরবঙ্গের জন্য বরাদ্দ হয়েছে মাত্র প্রায় ৮৬১ কোটি টাকা। অথচ প্রকৃত ব্যয় আরও কম।
দীপকবাবুর দাবি, “কলকাতার জন্য যে বরাদ্দ থাকে তার সিকিভাগেরও কম হয় উত্তরবঙ্গের ক্ষেত্রে। কেন্দ্র যখন উত্তরবঙ্গের পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বড় বড় প্রকল্প ঘোষণা করে তখন রাজ্য সরকারের একমাত্র ভূমিকা থাকে কীভাবে সেসব প্রকল্প বাস্তবায়নে বাধা দেওয়া যায়।
তিনি বলেন, জলপাইগুড়ি থেকে ঘোষপুকুর হয়ে অসম পর্যন্ত যে ‘ফোর লেন’ রাস্তা তৈরি হচ্ছে, সেই রাস্তাযর কাজ জমিজটের কারণে কাজ বারবার আটকে যাচ্ছে। এই জমিজট সাধারণ মানুষের কারণে নয়, বরং জমি অধিগ্রহণে ডিএম কার্যালয়ের মনগড়া ও অস্বচ্ছ ক্ষতিপূরণ নির্ধারণই এর মূল কারণ।
দীপকবাবু বলেন, একই দাগের জমিতে একজন মালিক ২ লক্ষ টাকা ডেসিমেল পাচ্ছেন, আরেকজন পাচ্ছেন মাত্র ৫০ হাজার টাকা। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষ ক্ষোভে জমি দিতে নারাজ হচ্ছেন। জমির মালিকদের বারবার চেষ্টা সত্ত্বেও ডিএম ও ডিএলএলআরও অফিস থেকে কোনও সঠিক তথ্য না দেওয়ায় পরিস্থিতি আরও জটিল হচ্ছে।
তিনি জানান, পুনর্বাসন দেওয়ার ক্ষেত্রেও রাজ্য সরকার পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করছে। তৃণমূলের দলীয় কর্মীরা পুনর্বাসন পেলেও সাধারণ মানুষ বঞ্চিত। উত্তরবঙ্গের জন্য বরাদ্দ এইমস (AIIMS) প্রকল্প, কোচবিহার ও রায়গঞ্জ মেডিকেল কলেজের জন্য ১১৩.৪০ কোটি এবং মালদহে ট্রমা সেন্টারের জন্য ১২০ কোটি টাকা থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার সেই অর্থ ব্যয় করতে গড়িমসি করছে। শিলিগুড়িতে রিং রোড তৈরির জন্য কেন্দ্র সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা অনুমোদন করেছে, কিন্তু রাজ্য সরকারের নিষ্ক্রিয়তার কারণে সেই কাজ আজও সম্পূর্ণ নয়।
তিনি অভিযোগ করেন, বাগডোগরা বিমানবন্দরের সম্প্রসারণে কেন্দ্রের উদ্যোগে রাতের বিমান চলাচল সম্ভব হলেও আলিপুরদুয়ার জেলার হাসিমারার এয়ারবেসের জমি দিতে রাজ্য রাজি নয়, যার ফলে সেখানকার সাধারণ মানুষের জন্য নতুন টার্মিনাল তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না ৩৭.৭৪ একর জমি না দেওয়ার একমাত্র কারণ।
তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গের মানুষকে রাজ্য সরকার মানুষ হিসাবে বিবেচনাই করে না। ১৯৯৩ সালের ভয়াবহ বন্যায় মুজনাই নদীর উপর ভেসে যাওয়া সেতুটি ৩২ বছরেও পুনর্নির্মাণ হয়নি। আজও সেই সেতুর জায়গায় বাঁশের অস্থায়ী সাঁকো দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ২০ হাজার মানুষ যাতায়াত করেন। একইভাবে পূর্ব কাঠালবাড়ির সঞ্জয় নদীর সেতু ২০ বছরের বেশি সময় ধরে ভাঙা অবস্থায় পড়ে রয়েছে।
তিনি অভিযোগ করেন, “গিরিয়ার সেতু মাঝখানে ভেঙে ধনুকের মতো হয়ে আছে এবং বিপজ্জনক অবস্থায় প্রতিদিন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, গ্রামের সাধারণ মানুষ যাতায়াত করছেন। তিনি জানান, এসব বিষয়ে বিধানসভায় কলিং অ্যাটেনশন, প্রশ্নোত্তর ও বিভিন্ন মাধ্যমে তুলে ধরেও ফল পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, প্রতিটি বিধানসভায় এ ধরনের বহু ঘটনা রয়েছে যেখানে মানুষের ন্যূনতম নাগরিক অধিকার পর্যন্ত লঙ্ঘিত হচ্ছে।
তিনি বলেন, উত্তরবঙ্গকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে কেন্দ্র সরকার একাধিক কাজ করলেও তৃণমূল পরিচালিত রাজ্য সরকার বিভিন্ন অজুহাতে উন্নয়ন রোধ করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থে রাস্তা থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যে উন্নয়ন কাজ চলছে, সেগুলোর সুবিধা মানুষের কাছে পৌঁছাতে রাজ্য ইচ্ছাকৃতভাবে বাধা দিচ্ছে।
এরপর শ্রী দীপক বর্মন বলেন, মুখ্যমন্ত্রীর উত্তরবঙ্গ সফরের মূল উদ্দেশ্য বালি-পাথরের সিন্ডিকেটের ওপর নজর রাখা। তিনি বলেন, বোল্ডার ও বালি চোরাচালানে উত্তরবঙ্গের বহু নদী নষ্ট হচ্ছে, নদীর গতিপথ পরিবর্তন হচ্ছে এবং ব্রিজের পিলার পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কয়েকটি থানার ওসি থেকে শুরু করে জেলার এসপি পর্যন্ত এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত। বনের বড় বড় গাছ কেটে ফেলে দেওয়া হয়েছে, ফলে আজ উত্তরবঙ্গের বহু বনাঞ্চলে ১০ থেকে ১৫ বছরের ছোট গাছ ছাড়া কিছুই নেই।
তিনি বলেন, ডুয়ার্সে হাতির আক্রমণে বিপুল মানুষ মারা যাচ্ছে, আহত হচ্ছে এবং যেসব মানুষ মারা যায় না তারা সর্বস্বান্ত হয়ে যাচ্ছেন, কারণ চিকিৎসার খরচ ১০ থেকে ১২ লক্ষ টাকায় পৌঁছায়। তিনি রাজ্য সরকারকে অনুরোধ করেন যে হাতির আক্রমণে আহত মানুষের সম্পূর্ণ চিকিৎসার দায়ভার সরকার গ্রহণ করুক। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী স্বাস্থ্য সাথী কার্ডের কথা বললেও তিনি জানান, তা অত্যন্ত অপ্রতুল।
সবশেষে তিনি নদীর বুক থেকে আর্থ মুভারের মাধ্যমে অত্যধিক বালি ওঠানো, পাহাড়ি নদীর গতিপথ বদলে যাওয়া এবং পরিবেশ ধ্বংসের বিষয়টি তুলে ধরে বলেন যে এই সরকার প্রকৃতির প্রতি কোনো দায়িত্ব পালন করছে না। সাধারণ মানুষ এসব অন্যায় দেখছে এবং সময়মতো জবাব দেবে।
---------------
হিন্দুস্থান সমাচার / অশোক সেনগুপ্ত