আগরতলা, ১২ অক্টোবর (হি.স.) : দক্ষিণ ত্রিপুরার বাংলাদেশ-সীমান্ত শহর সাব্রুমে এক পাকিস্তানি মহিলাকে গ্রেফতারের ঘটনায় গোটা রাজ্য তথা দেশজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। ধৃত জেল-পলাতক পাকিস্তানি মহিলা নিজেকে বছর ৬০-এর সাহেনা পারভিন বলে পরিচয় দিলেও তার আসল নাম লুইস নিঘাত আর্থার ভানু। তিনি নানান সময়ে নিজেকে লুইস নেগি বা নিঘাত নামেও পরিচয় দেন। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, লুইস নিঘাত মূলত পাকিস্তানের নাগরিক। অতীতে মানব পাচার ও মাদক চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকায় একাধিকবার বিদেশি কারাগারে বন্দি ছিলেন।
প্রাথমিক জেরায় মহিলাটি নিজেকে দিল্লির পুরানিবস্তির বাসিন্দা সাহেনা পারভিন বলে পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু দিল্লির বাসিন্দাজনিত কোনও বৈধ পরিচয়পত্র দেখাতে পারেননি তিনি। এর পর তার লটবহরে তালাশি করা হয়। ব্যাগ থেকে কয়েকটি পাকিস্তানি যোগাযোগের নম্বর সহ কিছু নথিপত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
উদ্ধারকৃত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, মহিলাটির আসল নাম লুইস নিঘাত আর্থার ভানু। তিনি পাকিস্তানের শেখুপুরা জেলান্তর্গত ইয়ঙ্গানাবাদ গ্ৰামের চক নম্বর ৩৭১-এর বাসিন্দা জনৈক মোহম্মদ গুল ফারাজের স্ত্রী, জানান পুলিশের ঊর্ধ্বতন আধিকারিক।
গতকাল রাত প্ৰায় ৮টা ৩০ মিনিট নাগাদ সাব্রুম রেলস্টেশনে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাঘুরির সময় তাকে আটক করে জিআরপি থানার পুলিশ। পরে তাকে হস্তান্তর করা হয় সাব্রুম থানায়। প্রথমে নিজের পরিচয় নিয়ে পরস্পরবিরোধী তথ্য দিতে থাকেন তিনি। কখনও বলেন তিনি পর্যটক, কখনও মানবিক কারণে ভারতে এসেছেন, আবার কখনও নিজের নাগরিকত্ব নিয়েও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দেন।
আজ (রবিবার) সকাল থেকেই বিএসএফ, গোয়েন্দা দফতর, জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং মহকুমা পুলিশের একটি বিশেষ দল তাকে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তার জবানবন্দি থেকে পাওয়া গেছে রোমহর্ষক তথ্য, ২০১৪ সালে পাকিস্তানি পাসপোর্ট ব্যবহার করে এক পাকিস্তানি বান্ধবীর সঙ্গে নেপালে যান লুইস নিঘাত। সেখানে ফিলিপিনসের এক মহিলার সঙ্গে এক কেজি হেরোইন সহ নেপাল পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সেই মামলায় তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেয় কাঠমাণ্ডু আদালত।
নেপালে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক আন্দোলনের সময় কারাগার ভেঙে অন্য বহু বন্দি পালিয়ে যায়। সেই অন্যদের মধ্যে ছিল নিঘাতও। পরবর্তীতে নেপাল পুলিশ পুনরায় কয়েকজন পলাতক কয়েদিকে ধরলেও, নিঘাতে গ্রেফতার করতে পারেনি। পাকিস্তান দূতাবাসের সঙ্গে সে যোগাযোগ করে। কিন্তু পাক-দূতাবাস জানিয়ে দেয়, সাজা শেষ না হলে তাকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। এর পরই সে নেপালের এক মানব পাচারকারীর সঙ্গে যোগসাজশ করে অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশ করে।
ভারতে ঢোকার পর তার চলাফেরার নকশা গোয়েন্দাদের চোখ কপালে তুলেছে। প্রথমে এক মানব পাচারকারীর তত্ত্বাবধানে উত্তরপ্রদেশ ও লখনউ, পরে বিহার, তার পর শিলিগুড়ি ও জলপাইগুড়ি ঘুরে শেষমেশ আগরতলায় পৌঁছে লুইস নিঘাত। আগরতলা পৌঁছে পাচার চক্রের এক সদস্য তাকে মোবাইলে জানায়, সাব্রুম সীমান্তে অবস্থান করতে হবে, সেখান থেকে বাংলাদেশে পাচার করে দেওয়া হবে তাকে।
সূত্র বলছে, সাব্রুমের এক মানব পাচারকারীর হাত থেকে বাংলাদেশের এক মানব পাচারকারী তাকে রিসিভ করার কথা ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা ভেস্তে যায় সাব্রুম জিআরপি-র তৎপরতায়।
পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, পাকিস্তানি এই মহিলা শুধু মানব পাচারের সঙ্গে নয়, একটি আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কের অংশ হতে পারেন, যার যোগসূত্র মাদক, মানব অঙ্গ ব্যবসা, এমন-কি গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গেও জড়িত হতে পারে। তার কাছ থেকে উদ্ধারকৃত নম্বর সহ একটি কি-প্যাড মোবাইল ফোন সমেত বহু নথি ইতিমধ্যেই বাজেয়াপ্ত করে তদন্ত শুরু হয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তার চলাফেরা এবং অবস্থান বেছে নেওয়ার ধরণ অত্যন্ত সুপরিকল্পিত এবং তা ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এক গুরুতর সতর্ক সংকেত। বিশেষ করে দীপাবলির প্রাক্কালে, যখন সাব্রুম হয়ে ভারত-বাংলাদেশের মৈত্রী সেতুতে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কার্যক্রম জোরদার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তখন এই বিদেশি মহিলার উপস্থিতি নিছক কাকতালীয় নয় বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা। ইতিমধ্যেই রাজ্যের উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিকরা সাব্রুমে পৌঁছেছেন। খবর পাওয়া গেছে, এনআইএ ও সেনা গোয়েন্দা শাখাও ঘটনার তদারকি করতে পারে।
তথ্যবিজ্ঞ মহলের মতে, নিঘাতের ভারত প্রবেশের মূল উদ্দেশ্য হয়তো মানব পাচারের আড়ালে তথ্য সংগ্রহ বা রিকনাইসেন্স মিশন পরিচালনা করা। তার বিদেশি যোগাযোগ, একাধিক দেশের ভিসা ইতিহাস এবং পরিচয় বদলের অভ্যাস গোটা ঘটনার রহস্য আরও ঘনীভূত করেছে।
বর্তমানে সাব্রুম থানায় তার বিরুদ্ধে বিদেশি নাগরিক আইন, পাসপোর্ট আইন এবং মানব পাচার প্রতিরোধ আইন অনুযায়ী মামলা রুজু হয়েছে। আগামীকাল আদালতে তাকে তোলা হবে। পুলিশ তাকে রিমান্ডে নেওয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে গোটা চক্রের পর্দা ফাঁস করা যায়।
দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক একাংশের মতে, এই ঘটনা শুধুমাত্র একটি সীমান্ত অপরাধ নয়, এটি ভারতীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থায় একটি সম্ভাব্য আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের প্রাথমিক ইঙ্গিত। প্রশ্ন উঠছে, সাব্রুমের মতো কৌশলগত শহরে এই বিদেশি মহিলা কী উদ্দেশ্যে এসেছিলেন?
গোটা দেশ এখন তাকিয়ে আছে সাব্রুমের দিকে, লুইস নিঘাতের মুখ থেকেই হয়তো বেরিয়ে আসবে এমন কিছু সত্য, যা ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে।
হিন্দুস্থান সমাচার / গোবিন্দ দেবনাথ