রবিবার গোরক্ষপুরে যোগানন্দকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন নিজামুদ্দিনরা
অশোক সেনগুপ্ত গোরক্ষপুর, ৪ জানুয়ারি (হি.স.): প্রতি বছরের মতো ৫ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের এক প্রাক্তন প্রয়াত বঙ্গসন্তানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন এক মুসলিম পরিবার। যোগদিবসের হুল্লোড় থেকে দূরে থাকা ওই পরিবার বিস্মৃত হননি হিন্দু পরমহংস যোগানন্দকে। ওই
রবিবার গোরক্ষপুরে যোগানন্দকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন নিজামুদ্দিনরা


রবিবার গোরক্ষপুরে যোগানন্দকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন নিজামুদ্দিনরা


প্রতিবেদককে বর্ণনা দিচ্ছেন নিজামুদ্দিন


অশোক সেনগুপ্ত

গোরক্ষপুর, ৪ জানুয়ারি (হি.স.): প্রতি বছরের মতো ৫ জানুয়ারি উত্তরপ্রদেশের এক প্রাক্তন প্রয়াত বঙ্গসন্তানকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবেন এক মুসলিম পরিবার। যোগদিবসের হুল্লোড় থেকে দূরে থাকা ওই পরিবার বিস্মৃত হননি হিন্দু পরমহংস যোগানন্দকে।

ওই পরমহংস গান্ধীজিকে ক্রিয়াযোগে দীক্ষা দিয়েছিলেন। গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতনেও! উনিশ শতকে শ্যামাচরণ লাহিড়ী গৃহস্থদের যোগশিক্ষা দেন, তাঁরই পরম্পরায় যোগানন্দ যুগ যুগ ধরে আমেরিকায় প্রচার করেন যোগ।

তরুণ সন্ন্যাসী যোগানন্দ। ভারত ও পাশ্চাত্যে ‘যোগদা সৎসঙ্গ সোসাইটি অব ইন্ডিয়া’ ও ‘সেল্ফ রিয়্যালাইজেশন ফেলোশিপ’ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা, পাশ্চাত্যে ‘ক্রিয়াযোগ’ প্রচার-প্রসারের প্রধান মুখ। ১৯২০ সালের অগস্টে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ভারত থেকে আমেরিকার পথে প্রথম যাত্রিবাহী জাহাজে দেশি-বিদেশি অসংখ্য যাত্রীর ভিড়ে মিশে ২৭ বছরের উজ্জ্বল মুখের ওই সন্ন্যাসী গিয়েছিলেন বস্টনের ‘ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অব রিলিজিয়াস লিবার‌্যালস ইন আমেরিকা’তে, ভারতের প্রতিনিধিত্ব করতে। তারপর, সে এক ইতিহাস।

কিন্তু স্মৃতির ধারাপাতে বিস্মরণের ধুলোয় হয়তো ঢাকা পড়ে গিয়েছে ওই যোগীর কীর্তি। ’২৪-এর ২ জানুয়ারি ভ্রাতৃসম প্রাক্তন সাংবাদিক অরবিন্দ দুবেকে নিয়ে গেলাম গোরক্ষপুরে তাঁর জন্মস্থানে। বেশ বেগ পেতে হল তালাবন্ধ বাড়িটির খোঁজ পেতে। চারপাশ সন্ধানী চোখে জরিপ করছি। ভগবান সহায় থাকায় ঠিক সে সময় ঠিক লাগোয়া প্রাচীন বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন শেখ নিজামুদ্দিন।

“১৮৯৩-এ শিকাগোর ধর্মমহাসম্মেলনে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। বাকি ইতিহাস বেদান্তের বিশ্বজয়ের ইতিহাস। আর সেই বছরেই উত্তর প্রদেশের গোরক্ষপুরে (যোগী আদিত্যনাথের কল্যাণে যে স্থান বরং এখন ঢের বেশি পরিচিত) জন্মালেন মুকুন্দলাল ঘোষ।” এ কথা জানিয়ে শিশির রায় লিখেছেন (আনন্দবাজার পত্রিকা, ১৭ জুন, ২০১৮), “চার ভাই চার বোনের সংসারে দ্বিতীয় পুত্র। বাবা বেঙ্গল নাগপুর রেলওয়ের বড় পদে ছিলেন, চাকরিসূত্রে ভারতের নানান শহরে ঘুরতে হয়েছে পরিবারটিকে। যে শহরেই বদলি হন, সেখানেই বাড়ির ঠাকুরঘরে ফ্রেমে বাঁধানো একখানা ছবি থাকত— ‘লাহিড়ীমশাই’, যোগীরাজ শ্যামাচরণ লাহিড়ীর ছবি। মুকুন্দের বাবা তাঁর মন্ত্রশিষ্য ছিলেন। শৈশব থেকেই মায়ের সঙ্গে ঠাকুরঘরে বিভোর বসে থাকত শিশুটি, একা থাকলেই ডুবে যেত তন্ময় নীরবতায়।”

৮০টিরও বেশি দেশে পরমহংস যোগানন্দের অনেক অনুসারী রয়েছে। আঞ্চলিক পর্যটন কর্মকর্তা রবীন্দ্র মিশ্র এ কথা জানিয়ে বলেন, “যোগানন্দের বাবা মূলত পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা ছিলেন। গোরক্ষপুরের কোতোয়ালির কাছে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তিনি। যোগানন্দ এখানে জন্মগ্রহণ এবং পড়াশোনা করেন। যোগের ক্ষেত্রে নাম করেন। অনেক দেশে ক্রিয়াযোগের প্রবর্তক হন। তিনি চেয়েছিলেন, তাঁর জন্মস্থানে একটি যোগ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠুক। এই প্রেক্ষাপটে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের নির্দেশে একটি প্রস্তাব তৈরি করে পর্যায়ক্রমে রূপায়ণ হবে। প্রথম কিস্তিতে ভবন নির্মাণ এবং জমির ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৯ কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। প্রকল্পটি হবে ৫০ কোটি টাকার। নির্মিত ভবন ও জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া চলছে।”

যোগানন্দের বাবা ভগবতী চরণ ঘোষ ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল তিরহুত রেলওয়ের (বর্তমানে উত্তর পূর্ব রেলওয়ে নামে পরিচিত) একজন কর্মচারী হিসাবে গোরক্ষপুরে নিযুক্ত হন। নিজামুদ্দিন এই প্রতিবেদককে জানালেন, “এই গোটা চত্বরের মালিকানা ছিল আমাদের। যোগানন্দের বাবা এই বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ওই ঘরটায় জন্মেছিলেন মুকুন্দলাল। পরবর্তীকালে বিশ্বজয় করেন। প্রতি বছর ৫ জানুয়ারি আমরা তাঁর জন্মদিন পালন করি। এবারেও করব।”

নিজামুদ্দিন জানালেন, “ওই দোতলা এবং পাশে, আমাদের বাড়িটা প্রায় সাড়ে চার হাজার বর্গফুট করে। ওই দুটো এবং সামনে, আশপাশে যে সব কাঠামো দেখছেন সব ভেঙে প্রায় ১৬ হাজার বর্গফুট জায়গা নিয়ে হবে প্রকল্প। আধ্যাত্মিক সংস্থার হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে পুরো জায়গা। বিনিময়ে ১৮ কোটি টাকা দিয়েছে। আমার বাবা শেখ আব্দুল রহিম বছর দুই হলো মারা গিয়েছেন। এখন পরিকল্পনার কথা হচ্ছে আমার সঙ্গে।”

শিশির রায় লিখেছেন, “কলকাতায় মুকুন্দদের বাড়ির ঠিকানা ৪ নং গড়পার রোড, অনতিদূরে ১০০এ গড়পার রোডে উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বাড়ি, যে বাড়িতে মৃত্যুশয্যায় শায়িত সুকুমার রায়কে এসে দেখে গিয়েছেন, গান শুনিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। আবার কাছেই আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর বাড়ি, সেখানেও বিজ্ঞানীকে দেখতে যান তরুণ মুকুন্দ। প্রবীণ বিজ্ঞানী তাঁকে ল্যাবরেটরিতে এসে তাঁর আবিষ্কৃত ক্রেস্কোগ্রাফ দেখে যেতে বলেন। প্রেসিডেন্সি কলেজ ছেড়ে জগদীশচন্দ্র স্থাপনা করলেন বসু বিজ্ঞান মন্দির, সেই উদ্বোধন-অনুষ্ঠানেও গিয়েছিলেন মুকুন্দ। বিশদে লিখে গিয়েছেন বিজ্ঞানীর সে দিনের ভাষণ, ‘অটোবায়োগ্রাফি অব আ যোগী’ বইয়েই। পরেও গিয়েছেন তাঁর কাছে, দেখেছেন ফার্নের গায়ে ক্রেস্কোগ্রাফ লাগিয়ে দেওয়ার পর পর্দায় তার ধীর অথচ সুস্পষ্ট বেড়ে ওঠা, ক্লোরোফর্ম প্রয়োগে তার থেমে যাওয়া, তীক্ষ্ণ অস্ত্রের আঘাতে তার যন্ত্রণায় স্পন্দিত হওয়া।”

গোরক্ষপুরে যোগানন্দের জন্মস্থানের দ্বিতল বাড়িটির ফলকে এক বেগ পরিবারের দুই পুরুষের নাম লেখা। দুই পুরুষের একজন ছিলেন প্রাক্তন সেনাকর্মী। অপরজন প্রাক্তন রেলকর্মী। নিজামুদ্দিনের কথায়, “ওঁরা বাড়িটি কিনে নিয়েছিলেন। এখন টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দিয়েছেন। কেউ থাকেন না।” বাড়িটির বয়স কত? নিজামুদ্দিন বলেন, “প্রায় ২০০ বছর হতে পারে।”

অনেক পরে যখন মুকুন্দ সন্ন্যাস নিয়ে যোগানন্দ হন, রাঁচিতে তৈরি করেন যোগদা সৎসঙ্গ ব্রহ্মচর্য বিদ্যালয়। তখন কলকাতায় এক দিন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর পরিচয় করিয়ে দেন সি এফ অ্যান্ড্রুজ। কবির আমন্ত্রণে শান্তিনিকেতনেও যান যোগানন্দ, যোগ অভ্যাসের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মনঃসংযোগের প্রক্রিয়া তাঁর কাছে শোনেন রবীন্দ্রনাথ। আমেরিকা থেকে ভারতে ফেরার পর ১৯৩৫ সালে ওয়ার্ধাতে গান্ধীজির আশ্রমেও আমন্ত্রিত হন যোগানন্দ। চমৎকার সেই অনুপুঙ্খ বর্ণনা। মহাত্মার মৌনব্রত, তাঁর খাওয়ার বর্ণনা, সরল আশ্রমিক জীবন, গো-পালন, সব কিছু লিখে গিয়েছেন যোগানন্দ। এ সবই জানিয়েছেন শিশির রায়।

১৯২৭ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট কলভিন কুলিজ ভারতীয় যোগী যোগানন্দকে রাজসমাদর দিয়েছিলেন। তিনিই এশিয়ার প্রথম ব্যক্তি হিসাবে হোয়াইট হাউসে ওরকম স্বীকৃতি পান। তার পর সিকি শতক মার্কিন মুলুকে জাগরুক রেখেছিলেন সেই সম্মান। সেই বঙ্গসন্তানের খবর আজ কজন বাঙালি জানি? আলোচনার আড়ালে থাকা বাঙালি যোগীকে ভোলেননি যোগী আদিত্যনাথ। তা জেনে এলাম সরেজমিনে।

---------------

হিন্দুস্থান সমাচার / অশোক সেনগুপ্ত




 

 rajesh pande