ফিরে দেখা ২০২৫: পশ্চিমবঙ্গে ধর্ম ও রাজনীতি প্রবাহিত হলো সমান্তরালভাবে
কলকাতা, ২৯ ডিসেম্বর (হি.স.): প্রায় বিদায়লগ্নে ২০২৫ সাল| আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬-এ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ফলে তা যে ঘটনাবহুল হবে তা বলাই বাহুল্য| ২০২৫-ও রাজ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে একাধিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী থে
পশ্চিমবঙ্গের দীঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দির পরিদর্শনের সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।


কলকাতার ঐতিহাসিক ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত গীতা পাঠ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ।


হুমায়ুন কবীর


কলকাতা, ২৯ ডিসেম্বর (হি.স.): প্রায় বিদায়লগ্নে ২০২৫ সাল| আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬-এ পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। ফলে তা যে ঘটনাবহুল হবে তা বলাই বাহুল্য| ২০২৫-ও রাজ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে একাধিক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনার সাক্ষী থেকেছে। আস্থা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির মিশেলে এই বছরটি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে শুধুমাত্র একটি ক্যালেন্ডারের পাতাতেই থাকলো না, বরং এই বছর বিবেচিত হচ্ছে গভীর সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের এক অধ্যায় হিসেবেই।

চলতি বছরের প্রায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত একের পর এক ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কর্মসূচি রাজ্যজুড়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে| কখনও তা ধর্মীয় পর্যটনের প্রসার, কখনওবা সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রতীক, আবার কখনও রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। এই সব ঘটনাপ্রবাহ শুধু রাজ্য বা দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, আন্তর্জাতিক স্তরেও নজর কেড়েছে।

জানুয়ারি: বছরের সূচনা হলো গঙ্গাসাগর মেলায় আস্থার সমাবেশে

চলতি বছরের সূচনা হয় দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগরদ্বীপে ঐতিহ্যবাহী গঙ্গাসাগরে পুণ্যস্নানের মাধ্যমে। ১৪ ও ১৫ জানুয়ারি মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে গঙ্গা ও বঙ্গোপসাগরের সঙ্গমস্থলে আনুমানিক ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ পুণ্যার্থী পুণ্যস্নানে অংশ নেন। রাজ্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা, পরিবহণ, স্বাস্থ্য পরিষেবা ও সমগ্র মেল পরিচালনায় সুচারুভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

‘সব তীর্থ বারবার, গঙ্গাসাগর একবার’—এই বহুল প্রচলিত প্রবাদকে সামনে রেখে লক্ষ লক্ষ মানুষ আস্থার টানে গঙ্গাসাগরে সমবেত হন।

মার্চ: মায়াপুরে আন্তর্জাতিক আধ্যাত্মিক সমাবেশ

মার্চ মাসে নদিয়া জেলার মায়াপুরে ইসকনের চন্দ্রোদয় মন্দির প্রাঙ্গণে ভগবান নৃসিংহদেবের বিগ্রহের অভিষেক হয়| এই উপলক্ষে বৃহৎ আধ্যাত্মিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ইসকন অনুগামীদের অংশগ্রহণে মায়াপুর ফের আন্তর্জাতিক আধ্যাত্মিক মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে উঠে আসে।

এপ্রিল: দিঘায় জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধন ঘিরে জাতীয় স্তরে আলোচনা

এপ্রিল মাসে পূর্ব মেদিনীপুরের দিঘা জাতীয় স্তরের আলোচনায় উঠে আসে। ৩০ এপ্রিল অক্ষয় তৃতীয়ার দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিঘায় নবনির্মিত জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধন করেন। প্রায় ৬৫ মিটার উচ্চতার এই মন্দিরটি ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে নির্মিত| মন্দির নির্মাণে রাজস্থান থেকে আনা বিশেষ বেলেপাথর ব্যবহার করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে এই প্রকল্পকে ধর্মীয় পর্যটন উন্নয়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ হিসেবে তুলে ধরা হয়। একই সঙ্গে এটি ঘিরে ওড়িশা সরকারের সঙ্গে কিছু মতবিরোধ দেখা যায়।

জুলাই: দুর্গা অঙ্গন প্রকল্পে সংস্কৃতি ও পর্যটনের সংযোগ

২১ জুলাই শহিদ দিবসের মঞ্চ থেকে মুখ্যমন্ত্রী কলকাতার নিউ টাউন এলাকায় ‘দুর্গা অঙ্গন’ নির্মাণের ঘোষণা করেন। এরপর জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটির প্রশাসনিক প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং হিডকো কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জমি বরাদ্দ করা হয়। প্রস্তাবিত দুর্গা অঙ্গনে থাকবে সংগ্রহশালা, শিল্প গ্যালারি এবং দুর্গাপুজোর বিভিন্ন রূপ তুলে ধরার স্থায়ী প্রদর্শনী। ইউনেস্কো স্বীকৃত বাংলার দুর্গাপুজোর ঐতিহ্যকে সারা বছর পর্যটকদের সামনে তুলে ধরাই এই প্রকল্পের মূল লক্ষ্য।

অক্টোবর: দুর্গাপুজো ও রেড রোড কার্নিভালে বিশ্বমঞ্চে বাংলা

অক্টোবর মাসে দুর্গাপুজো ও রেড রোড কার্নিভালের মাধ্যমে কলকাতা ফের আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয় দৃঢ় করে। ইউনেস্কোর হেরিটেজ তকমা পাওয়ার পর দুর্গাপুজো কেবল ধর্মীয় উৎসবের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়| সেসব ছাড়িয়ে সাংস্কৃতিক সৃজনশীলতা ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

ডিসেম্বর: ধর্মীয় কর্মসূচি ও রাজনৈতিক আলোচনার আবহ

বছরের শেষভাগে ধর্মীয় কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা তীব্র হয়। ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যায় বিতর্কিত বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দিনে, তৃণমূল কংগ্রেসের বরখাস্ত বিধায়ক হুমায়ুন কবির মুর্শিদাবাদের রেজিনগরে বাবরি মসজিদের আদলে তৈরি একটি মসজিদ ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। এই ধর্মীয় নির্মাণ এর সূচনা ঘিরে রাজ্য রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।

৭ ডিসেম্বর, কলকাতার ঐতিহাসিক ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড এক ভিন্ন দৃশ্যর সাক্ষী হয়। প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষ একযোগে শ্রীমদভগবদ গীতা পাঠ করেন। বিপুল সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণে এই কর্মসূচিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা উপস্থিত ছিলেন।

বছরের শেষলগ্নে বিশ্ব আধ্যাত্মিক সম্মেলন

২৬ ও ২৭ ডিসেম্বর কলকাতার সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত ১৬তম ওয়ার্ল্ড স্পিরিচুয়াল কনফ্লুয়েন্স। রাজ্যপাল ড. সি. ভি. আনন্দ বোসের উপস্থিতিতে বিভিন্ন ধর্মের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা বিশ্ব শান্তি, সহাবস্থান ও পারস্পরিক বোঝাপড়া নিয়ে আলোচনা করেন। এই সম্মেলন বছরজুড়ে চলা ধর্মীয় সংলাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সামগ্রিকভাবে ২০২৫ সাল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে আস্থা, সংস্কৃতি, পর্যটন ও রাজনীতির সমন্বয়ে গঠিত একটি উল্লেখযোগ্য বছর হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক আয়োজনগুলি কেবল আচার-অনুষ্ঠানে সীমাবদ্ধ না থেকে সামাজিক পরিচয় ও রাজনৈতিক বাস্তবিকতার সঙ্গেও যুক্ত হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এই বছরটির প্রভাব আগামী দিনে রাজ্যের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে দীর্ঘস্থায়ী হয়ে থাকতে পারে।

---------------

হিন্দুস্থান সমাচার / সৌমি বৈদ্য




 

 rajesh pande