।। রাজীব দে ।।
চট্টগ্রাম, ১২ এপ্রিল (হি.স.) : বাংলাদেশের পাহাড়ে শুরু প্রাণের উৎসব বৈসাবী। পাহাড়-হ্রদ আর অরণ্যের শহর রাঙামাটি সহ তিন পার্বত্য জেলার পাহাড়ে বর্ষবিদায় এবং বর্ষবরণের মহান উৎসব, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। চাকমাদের ভাষায় এই উৎসবকে বিঝু, ত্রিপুরীদের ভাষায় বৈসুক, মারমাদের ভাষায় সাংগ্রাই এবং তংচঙ্গ্যাদের ভাষায় বিসু এবং অসমিয়াদের ভাষায় বিহু নামে পরিচিত।
তিনদিন ব্যাপী এই উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমা ভাষায় ফুল বিঝু, দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিঝু’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবঝর’ বা ‘গোজ্যা পোজ্যা দিন’ বলা হয়। এভাবেই ত্রিপুরীরা প্রথম দিনকে ‘হারিকুইসুক’ দ্বিতীয় দিনকে ‘বুইসুকমা’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘বিসিকাতাল’ নামে অভিহিত করে থাকেন। এই বৈসাবী উৎসবকে ঘিরে টানা তিনদিন পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে বিরাজ করে এক অসাধারণ উচ্ছ্বলতা। পাহাড়ের আদি বাসিন্দারা মহা সমারোহে পালন করেন তাঁদের সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব বৈসাবি।
বৈসাবী উপলক্ষে রাঙমাটিতে ৯ এপ্রিলের প্রথম প্রহরে বিজু, সাংগ্রাই, বিষু, বিহু উদযাপন কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা। আজ ১২ এপ্রিল শনিবার সকাল সাড়ে ছয়টায় রাজবাড়ি ঘাটে এবং সকাল আটটায় শহরের ত্রিপুরাপল্লি খ্যাত গর্জনতলিতে ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে কাপ্তাই হ্রদে অনুষ্ঠিত হয়েছে ফুল ভাসানো অনুষ্ঠান।
অপরদিকে, আগামী ১৫ এপ্রিল মঙ্গলবার প্রতি বছরের মতো এবারও বৈসাবী উপলক্ষ্যে মারমা সাংস্কৃতিক সংস্থা (মাসস)-র উদ্যোগে রাঙামাটির রাজস্থলী উপজেলার বাঙালহালিয়া মাঠে এবং ১৯ এপ্রিল রাঙামাটি মারী স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হবে মারমাদের ঐতিহ্যবাহী জল উৎসব ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বৈসুক : ত্রিপুরীদের ধর্মীয় এবং সামাজিক উৎসবের মধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং প্রধানতম উৎসব বুইসুক বা বৈসুক চৈত্র মাসের শেষের দুদিন এবং নববর্ষের প্রথমদিন সহ মোট তিনদিন ধরে পালন করা হয়। চৈত্রমাসের শেষ দুদিনের প্রথমদিনকে ত্রিপুরীরা ‘হারি বুইসুক’ এবং শেষ দিনটিকে ‘বুইসুকমা’ বলে থাকেন। আর নববর্ষের প্রথমদিনকে তাঁরা বলেন ‘বিসিকাতাল’। উৎসবের প্রথমদিন ত্রিপুরী ছেলেমেয়েরা ফুল তুলেন। ফুল দিয়ে ঘর সাজান। কাপড়-চোপড় ধুয়ে পরিষ্কার করেন। ঝুড়িতে ধান নিয়ে তাঁরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মোরগ-মুরগিকে ছিটিয়ে দেন। গৃহপালিত সব প্রাণীকে খুব ভোরে ছেড়ে দেন তাঁরা। পরিচ্ছন্ন কাপড়-চোপড় পরে ছেলেমেয়েরা গ্রামের ঘরে ঘরে ঘুরে বেড়ান। ছেলেমেয়েদের বিচিত্র পিঠা আর বড়দের মদ ও অন্যান্য পানীয় পান করানো হয়।
বৈসুক শুরুর দিন থেকে ‘গরয়া’ নৃত্যের দল গ্রামে গ্রামে গিয়ে প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে নৃত্য করে। এই আনন্দদায়ক ও চিত্তাকর্ষক নৃত্যকে ত্রিপুরীরা গরয়া নৃত্য বা খেরেবাই নৃত্য বলে থাকেন। এই নৃত্যে ২২টি অসাধারণ মুদ্রা সৃষ্টি করা হয়। এই নৃত্য দলের শিল্পীদের একজনের কাঁধে একটি শূল থাকে। এই শূলে একটি খাদি বাঁধা থাকে। যদি কোনও বাড়ির উঠোনে এই শূলটি বসানো হয়। বাড়ির মালিককে গরয়া দেবতার পূজা দিতে হয়। এভাবে প্রত্যেক বাড়ির উঠোনে নৃত্য শেষে শিল্পীদের মদ, মুরগির বাচ্চা, চাল প্রভৃতি দেওয়া হয়। বিনিময়ে শিল্পীরা সুর করে সেই গৃহস্থকে আশীর্বাদ করে যান।
নৃত্য শেষে শিল্পীরা উপঢৌকন হিসেবে প্রাপ্ত সামগ্রীসমূহ দিয়ে গরয়া দেবতার পূজা করেন। কোনও শিল্পী যদি একবার এই গড়াইয়া নৃত্যে অংশ নেন, তা-হলে তাঁকে তিনবছর পর পর এই নৃত্যে অংশ নিতে হয়, নতুবা তাঁর অমঙ্গল, এমন-কি মৃত্যু হয় বলে মিথ আছে। এই লোকনৃত্যে ১৬ থেকে ১০০, ১৫০, ৫০০ জন পর্যন্ত অংশ নিতে পারেন। বৈসুক উৎসবের জনপ্রিয় এবং আকর্ষণীয় নৃত্য দেখার জন্য প্রত্যেক বৈসুকে সারা দেশের শত শত সংস্কৃতিকর্মী ও শিল্পী পার্বত্য চট্টগ্রামে আসেন।
সাংগ্রাই : বৈসাবি উৎসবের ‘সা’ আদ্যক্ষরটি অন্যতম আদিবাসী জনগোষ্ঠা মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ উৎসব থেকে নেওয়া। মারমাদের অন্যতম সামাজিক উৎসব হলো সাংগ্রাই। মারমারা সাধারণত মঘীসনের চান্দ্র মাস অনুসারে এই দিনটি পালন করে থাকেন। বছরের শেষ দুদিন এবং নববর্ষ ও প্রথমদিন, এই তিনদিন পালিত হয় এই উৎসব। সাংগ্রাই উৎসব উদযাপনের সময় মারমা যুবক-যুবতীরা পিঠা তৈরি করার জন্য চালের গুঁড়া তৈরি করেন। এই সময় ‘পানি খেলা’ (জলক্রীড়া) হয়। সাংগ্রাই উৎসব এবং জলক্রীড়া এখন যেন একে অপরের সমার্থক হয়ে গেছে। এই খেলার সময় এক জায়গায় জল ভর্তি রেখে যুবক-যুবতীরা একে অপরের দিকে জল ছুঁড়ে মারেন। স্নিগ্ধতায় ভিজিয়ে দেন পরস্পরকে। এছাড়া এই দিন মারমারা বুদ্ধমন্দিরে গিয়ে ধর্মীয় বাণী শ্রবণ করেন। ঘিলার বিচি দিয়ে ‘ঘিলা খেলা’ এ সময় মারমাদের একটি প্রিয় খেলায় পরিণত হয়। চৈত্র সংক্রান্তি উপলক্ষ্যে সাংগ্রাই উৎসব পালন করা হয় বলে ধারণা করা হয়। সংক্রান্তি শব্দ থেকেই সাংগ্রাই শব্দটি এসেছে।
বিঝু : পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় আদিবাসী সম্প্রদায় চাকমা জনগোষ্ঠী। বিঝু তাই এখানে এনে দেয় এক অন্য রকম অনূভূতি আর মোহনীয় আবেশ। এই উৎসবের সাথে তাই যেন দুলে ওঠে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রাম। উৎসবরে প্রথমদিনকে চাকমারা বলেন ‘ফুলবিঝু’। এ দিন বিঝুর ফুল তোলা হয় এবং ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়। পরে সেই ফুল দিনান্তে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। বিঝুর সময় ছোট-ছোট ছেলেমেয়েরা পরিচ্ছন্ন কাপড় পরে দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি বেড়াতে যায়। তারা সবাই বয়স্কদের প্রণাম করে এবং ঘরের হাঁস মুরগিকে ধান চাল ছিটিয়ে দিয়ে খাওয়ায়। এ সময় ঘরে ঘরে রান্না করা হয় ‘পাজোন’ নামের এক বিখ্যাত খাবার। হরেকরকম সবজি আর তরকারির সমন্বয়ে রান্না করা খাবার এই উৎসবে সবার প্রিয় খাবার হয়ে ওঠে। গ্রামের ছেলেমেয়েরা ঘিলা খেলা, গুদু (হাডুডু) খেলায় মেতে ওঠে। আকাশপ্রদীপ জ্বালানো এবং বাজিপটকা পোড়ায় মহানন্দে। বয়স্করা মদ ‘জগরা’ বা ‘কাঞ্জি’ পান করেন। বিঝু উৎসবের সময় কোনও প্রাণী হত্যা করা হয় না। তবে নববর্ষের দিন মাছ মাংস সহ মজার মজার সব খাবারের আয়োজন থাকে। কেননা এই দিন ভালো কিছু খেলে সারা বছর ধরে ভালো খাবার-দাবার করার সম্ভাবনা থাকে বলে তাঁরা বিশ্বাস করেন।
প্রতিবছর বৈসাবি উৎসব আসে। পাহাড়ে ছড়িয়ে পড়ে প্রাণের ছোঁয়া। নব আনন্দে জাগে পাহাড়ের আদিবাসী প্রাণ। সমগ্র পার্বত্যাঞ্চল জুড়ে শুরু হয় এক মহা মিলনের মেলা।
হিন্দুস্থান সমাচার / সমীপ কুমার দাস