কলকাতা, ৬ অক্টোবর (হি.স.): টেরাকোটা থেকে বস্ত্রশিল্প, বাংলার শিল্পক্ষেত্রকে শক্তিশালী করতে জিএসটি সংস্কার হয়েছে। এই বিষয়ে জানিয়েছে ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি )।
পিআইবি-র তরফে জানানো হয়েছে, মূল প্রাপ্তিগুলি, জিএসটি ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করা হয়েছে, যার ফলে কারুশিল্প, তাঁত, পাট, চামড়া, পোশাক-সহ বিভিন্ন পণ্যের দাম ৬% থেকে ১১% পর্যন্ত হ্রাস পাবে।
এর মাধ্যমে ১০ লক্ষেরও বেশি জীবন উপকৃত হবে; যার মধ্যে ৪,০০০ বাঁকুড়ার টেরাকোটা শিল্পী থেকে শুরু করে চর্মশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ৫ লক্ষ কর্মী রয়েছেন।
বর্তমানে ২,৫০০ টাকা পর্যন্ত পোশাকের উপর ৫% হারে কর ধার্য করা হয়েছে, যা ৫ লক্ষ হোসিয়ারি কর্মীকে সুবিধা দেবে এবং রপ্তানিকে ত্বরান্বিত করবে।
মালদার আম এবং দার্জিলিং চায়ের মতো বিশেষ কৃষি পণ্যগুলি প্রক্রিয়াজাত খাদ্য সামগ্রী হিসাবে নতুন ৫% জিএসটির ফলে লাভবান হবে।
ভূমিকা
ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প, হস্তশিল্প এবং কৃষিনির্ভর শিল্পের জন্য পশ্চিমবঙ্গ দীর্ঘকাল ধরে সুপরিচিত। বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির মন্দির থেকে শুরু করে নকশি কাঁথার সূক্ষ্ম কাজ, পুরুলিয়ার প্রাণবন্ত মুখোশ থেকে শুরু করে বিশ্বজুড়ে সমাদৃত দার্জিলিং চা - বাংলার এই কারুকার্য ও শিল্প ঐতিহ্য লক্ষ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থানে সাহায্য করেছে। জিএসটি সংস্কারগুলি বাংলাকে কারুশিল্প ও উদ্যোগের কেন্দ্র হিসেবে আরও শক্তিশালী করে তুলবে, একই সঙ্গে এটি নিশ্চিত করবে যে স্থানীয় সমাজ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারেই স্থায়িত্ব লাভ করতে পারবে।
এই পরিবর্তনের ফলে বাংলার কারুশিল্পী, কৃষক এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সরাসরি ক্ষমতাবৃদ্ধি হবে, যার ফলে তাদের পণ্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারেই আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে। এটি কেবল বাংলার শিল্প ঐতিহ্যকেই উৎসাহিত করবে না, বরং জেলা জুড়ে স্থানীয় অর্থনীতিকেও শক্তিশালী করবে।
বস্ত্রশিল্প এবং ক্ষুদ্র, ও মাঝারি উদ্যোগ
নকশি কাঁথা
নকশি কাঁথা বাংলার অন্যতম প্রসিদ্ধ সূচিকর্মের ঐতিহ্য, যা বীরভূম, মুর্শিদাবাদ এবং নদীয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচলিত। পুরোনো শাড়ি ও ধুতি পুনর্ব্যবহার করে লেপ তৈরির এই মিতব্যয়ী ধারণা থেকেই কাঁথা সূচিকর্মের জন্ম। কালক্রমে এটি এক উজ্জ্বল শিল্প রূপে বিকশিত হয়েছে যা গ্রামীণ মহিলাদের আর্থিক স্বাধীনতা এবং সৃজনশীল অভিব্যক্তি - উভয়ই প্রদান করে। বর্তমানে এটি গ্রামীণ মহিলাদের আয়ের এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস, যাঁরা প্রায়শই স্বনির্ভর গোষ্ঠী বা পারিবারিক স্তরে কাজ করেন।
১২% থেকে কমে জিএসটি ৫% হওয়ার ফলে দাম প্রায় ৬.২৫% কমে যাওয়ায় এই ক্ষেত্রটি সরাসরি উপকৃত হবে। উদাহরণস্বরূপ, একটি জমকালো কাঁথা-সেলাই করা শাড়ি বা শাল যার দাম ৮,০০০ টাকা, এখন ৫০০ টাকা কমে পাওয়া যাবে। এর ফলে, দেশীয় বাজারে খাঁটি, হাতে-তৈরি কাঁথা আরও সাশ্রয়ী হবে এবং মেশিন-সেলাই করা বা গণ-উৎপাদিত নকল পণ্যের বিরুদ্ধে এর প্রতিযোগিতা ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
আন্তর্জাতিক বাজারে, বিশেষ করে ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং জাপানে, এই ঐতিহ্যবাহী সূচিকর্মটি - এর সূক্ষ্ম হাতে-সেলাই এবং অনন্য নান্দনিকতার জন্য সমাদৃত। এই অঞ্চলগুলির মধ্যে এটি ন্যায্য বাণিজ্য এবং সুস্থায়ী ফ্যাশন বাজারেও একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছে। দামের সাশ্রয় এবং লাভের মার্জিন বৃদ্ধি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ক্ষমতা বাড়াবে এবং এর বাজারের প্রসার ঘটাবে।
পাটের হাতব্যাগ ও শপিং ব্যাগ
পশ্চিমবঙ্গ ভারতের পাট শিল্পের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত, এখানকার সংগঠিত কারখানাগুলি আড়াই লক্ষেরও বেশি কর্মীর সরাসরি কর্মসংস্থান করে এবং প্রায় ৪০ লক্ষ কৃষক পরিবারকে সহায়তা করে।
এই শিল্পের বার্ষিক লেনদেন ১০,০০০ কোটি টাকারও বেশি, যার প্রায় ৭০% উৎপাদন হল প্রথাগত চটের বস্তা, যা খাদ্যশস্য প্যাকেজিংয়ের জন্য সরকার সংগ্রহ করে থাকে। এছাড়াও, ফ্যাশন ব্যাগ এবং সাজসজ্জার সামগ্রীর মতো বৈচিত্র্যপূর্ণ পাটজাত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।
জিএসটি ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করার ফলে খুচরো মূল্য প্রায় ৬.২৫% হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ১,০০০ টাকা মূল্যের একটি ব্যাগের ক্ষেত্রে ক্রেতারা ৬০ টাকারও বেশি সাশ্রয় করতে পারবেন, যা পরিবেশবান্ধব পাটকে প্লাস্টিক বা সিনথেটিক বিকল্পের তুলনায় আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক করে তুলবে। এটি শহুরে বাজারে অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়াবে এবং একই সাথে রপ্তানিকেও সমর্থন করবে, যেখানে পাটজাত বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্যের চাহিদা ইতিমধ্যেই প্রচুর।
পশ্চিমবঙ্গের কারুশিল্পী ও শ্রমিকদের জন্য এই কর ছাড় লাভজনক হবে এবং বাজারে প্রবেশাধিকার বাড়বে, পাশাপাশি, প্রতিযোগিতার ক্ষমতাও বৃদ্ধি করবে। এই ধরনের মূল্য সংযোজিত, ক্রেতা-মুখী পণ্যগুলিকে লক্ষ্য হিসাবে ধরার মাধ্যমে, জিএসটি হ্রাস গোল্ডেন ফাইবার-এর পরিচিতিকে আধুনিক জীবনধারার সঙ্গে প্রাসঙ্গিক করে তুলবে।
হোসিয়ারি ও রেডিমেড বা তৈরি পোশাক
হোসিয়ারি এবং রেডিমেড পোশাক পশ্চিমবঙ্গের বৃহত্তম শিল্পগুলির মধ্যে অন্যতম, যেখানে আনুমানিক পাঁচ লক্ষ শ্রমিক নিযুক্ত। কলকাতা ভারতের হোসিয়ারি শিল্পের ঐতিহাসিক জন্মস্থান, যার প্রধান স্থানগুলি হল-মেটিয়াবুরুজ, বারুইপুর এবং শিলিগুড়ি। এই শিল্পে লাক্স, রূপা, ডলারের মতো কয়েকটি বড় ব্র্যান্ড রয়েছে, যারা হাজার হাজার ছোট, অনিবন্ধিত ইউনিটের কাছে উৎপাদনের কাজ আউটসোর্স করে থাকে।
৫% জিএসটি ধাপের সীমা ২,৫০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করাটাই সবচেয়ে প্রভাবশালী পরিবর্তন। যদিও ৫% করের হার অপরিবর্তিত রয়েছে, তবুও এই সংশোধিত সীমার কারণে ইনারওয়্যার, বাচ্চাদের পোশাক এবং টি-শার্ট-সহ বেশিরভাগ মাঝারি দামের পোশাক এখন নিম্ন করের আওতায় এসেছে।
এই কর ছাড় উপভোক্তা এবং প্রস্তুতকারক - উভয়কেই সুবিধা দেবে। সাশ্রয় ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায়, গ্রাহকের চাহিদা বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এছাড়াও, পশ্চিমবঙ্গের হস্তচালিত তাঁত ও বস্ত্রজাত পণ্যের প্রায় ১২% রপ্তানি করা হয়। নতুন কর হারের ফলে রপ্তানি আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক হবে। করের বোঝা কমানোর মাধ্যমে এই সংস্কার শ্রম-নিবিড় একটি ক্ষেত্রকে সহায়তা করছে, যা বাংলার অর্থনীতি ও ঐতিহ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
উদ্যানজাত পণ্য
দার্জিলিং চা নির্যাস এবং এসেন্স
দার্জিলিং এবং কালিম্পং জেলার কুয়াশাচ্ছন্ন পাহাড়ের দার্জিলিং চা হল বিশ্ব-বিখ্যাত- বিশেষ করে, বিলাসবহুল কালো চা-যাকে প্রায়শই চা-এর শ্যাম্পেন নামে অভিহিত করা হয়। এর অনন্য মাস্কাটেল গন্ধটি এই অঞ্চলের নির্দিষ্ট কৃষি-জলবায়ুগত পরিস্থিতি থেকে আসে, যার মধ্যে রয়েছে উচ্চতা, ঠান্ডা আবহাওয়া এবং চিনা ক্যামেলিয়া সাইনেন্সিস চা গাছ। এই শিল্পটি ঐতিহাসিকভাবে এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক কাঠামো তৈরি করেছে। এটি এমন একটি বাগান মডেলের অধীনে পরিচালিত হয় যা লক্ষ লক্ষ মানুষকে কর্মসংস্থান দেয় এবং যার কর্মীর মধ্যে মহিলারা সংখ্যায় বেশি। এই শ্রমিকরা এস্টেটেই বসবাস করেন এবং চা চাষ তাদের জীবিকার মেরুদণ্ড।
সাধারণ চায়ের উপর জিএসটি ৫% থাকলেও, চা নির্যাস, এসেন্স এবং কনসেনট্রেটগুলির উপর করের হার ১৮% থেকে কমিয়ে ৫% করা হয়েছে। এর ফলে, খরচ প্রায় ১১% হ্রাস পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যার ফলস্বরূপ, ইনস্ট্যান্ট চা, রেডি-টু-ড্রিঙ্ক পানীয় এবং খাদ্য ও কসমেটিক শিল্পে ব্যবহৃত নির্যাসগুলির মতো মূল্য সংযোজিত পণ্যগুলি উল্লেখযোগ্যভাবে সাশ্রয়ী হবে।
এই কর ছাড় সরাসরি দার্জিলিং চায়ের রপ্তানি-নির্ভর প্রকৃতির জন্য লাভজনক, যা ভারতের প্রথম জিআই ট্যাগ প্রাপ্ত পণ্য। এটি একটি রপ্তানিমুখী পণ্য, যা জাপান, জার্মানি, যুক্তরাজ্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলিতে বিশাল বাজার খুঁজে পায়, যেখানে প্রক্রিয়াজাত চায়ের চাহিদা ক্রমশ বাড়ছে। মূল্য সংযোজিত পণ্য তৈরি করে বৈচিত্র্য আনার উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে, এই সংস্কার ঐতিহ্যবাহী পাতা চায়ের বিক্রির উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা কমাবে এবং নতুন আয়ের পথ খুলে দেবে।
সব মিলিয়ে, জিএসটির হার হ্রাস দার্জিলিং চা শিল্পের অর্থনৈতিক সক্ষমতাকে বলবান করবে এবং নিশ্চিত করবে যে, এই ঐতিহ্যবাহী পণ্যটি দেশীয় বিশেষ বাজার এবং আন্তর্জাতিক প্রিমিয়াম পানীয় শিল্প - উভয় ক্ষেত্রেই তার বিকাশকে বজায় রাখুক।
মালদার আম প্রক্রিয়াকরণ শিল্প
বাংলার আমের রাজধানী নামে পরিচিত মালদা জেলায় ২০০টিরও বেশি উন্নতমানের আম উৎপাদিত হয়। এর বিখ্যাত ফজলি, লক্ষ্মণ ভোগ এবং ক্ষীরসাপাতি (হিমসাগর) জাতের আমগুলি জিআই ট্যাগ প্রাপ্ত, যা এই অঞ্চলের পরিচিতির প্রতীক। আম চাষ মালদার অর্থনীতির মূল ভিত্তি; প্রায় ৮০,০০০ আম চাষি-সহ মোট ৪.৫ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই শিল্পের সাথে যুক্ত।
গড়ে প্রতি বছর মালদায় প্রায় ৩.৫ লক্ষ মেট্রিক টন আম উৎপাদিত হয়, যার একটি ক্রমবর্ধমান অংশ মণ্ড, জুস, জ্যাম এবং আচারে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। এই পণ্যগুলির দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবল চাহিদা রয়েছে। ২০২৩ সালে মালদা থেকে আমের রপ্তানি ৮০ কোটি টাকারও বেশি হয়েছে। জিআই ট্যাগ প্রাপ্ত আমগুলি মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ এবং সম্প্রতি সুইডেন ও নিউজিল্যান্ডের মতো নতুন বাজারেও রপ্তানি হচ্ছে।
প্রক্রিয়াজাত আমের পণ্য, জুস এবং জ্যামের উপর জিএসটি ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করার ফলে এর খুচরো মূল্য প্রায় ৬.২৫% হ্রাস পাবে। এর ফলে, প্রক্রিয়াজাত পণ্যগুলি অভ্যন্তরীণ গ্রাহকদের জন্য আরও সাশ্রয়ী হবে এবং খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে উৎসাহিত করবে। চাহিদা বৃদ্ধি এবং উৎপাদিত পণ্যের একটি নিশ্চিত বাজার তৈরি হওয়ায়, কৃষকদের আয়ও আরও স্থিতিশীল হবে।
বাঁকুড়া পাঁচমুড়া টেরাকোটা শিল্প
বাঁকুড়া জেলা, বিশেষ করে পাঁচমুড়া গ্রাম এবং বিষ্ণুপুর অঞ্চলে, টেরাকোটার কাজ স্থানীয় লোকেদের একটি বংশানুক্রমিক পেশা। বিখ্যাত বাঁকুড়া পাঁচমুড়ার টেরাকোটা মূর্তিগুলি - যার মধ্যে বাঁকুড়ার স্টাইলাইজড ঘোড়াটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য - সপ্তদশ শতকে বিষ্ণুপুরের মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় উদ্ভূত হয়েছিল। বর্তমানে ৪,০০০ জনেরও বেশি শিল্পী এই শিল্পটি বহন করে চলেছেন, যার বেশিরভাগই মহিলা সহ পরিবার-ভিত্তিক উদ্যোগ। স্থানীয় বাজার এবং কলকাতার হস্তশিল্প মেলার মত সরকারি মেলাগুলি এর প্রধান বিক্রয় কেন্দ্র।
বাঁকুড়ার টেরাকোটা হস্তশিল্পের জন্য জিএসটি ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করাটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ, যার ফলে খুচরো মূল্য প্রায় ৬.২৫% হ্রাস পাবে। উদাহরণস্বরূপ, ৫,০০০ টাকায় বিক্রি হওয়া একটি বড় আলংকারিক টেরাকোটা ঘোড়ার উপর, ক্রেতারা কর বাবদ প্রায় ৩১২ টাকা সাশ্রয় করবেন। এই সাশ্রয়ের পরিমাণ চাহিদা বৃদ্ধি করবে এবং বিক্রয়কে উৎসাহিত করবে, যা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত পরিবারগুলির জীবিকার মান উন্নত করবে।
মাদুরকাঠি এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্য
পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় হাজার হাজার পরিবার মাদুরকাঠি দিয়ে মাদুর ও বিভিন্ন পণ্য বোনে। পশ্চিম মেদিনীপুরের সবং এই শিল্পের বৃহত্তম কেন্দ্র, যেখানে মহিলারা বুনন প্রক্রিয়ায় নেতৃত্ব দেন। বহু পরিবারের কাছে মাদুর বোনা কেবল একটি ঐতিহ্য নয়, কারণ ৭৭%-এরও বেশি শিল্পী এটিকে তাদের আয়ের প্রধান উৎস হিসাবে ব্যবহার করেন। প্রায় ১ লক্ষ কৃষক পরিবার মাদুর-ঘাস চাষ এবং মাদুর বোনার কাজে নিযুক্ত, এবং মেদিনীপুরের ১১টি ব্লকে ৪,৪৩২ জন শিল্পী আনুষ্ঠানিকভাবে মাদুর শিল্পী হিসেবে নথিভুক্ত।
বাংলার আর্দ্র জলবায়ুতে মাদুর গৃহস্থালীর একটি অপরিহার্য অংশ, অন্যদিকে ব্যাগ, টেবিল রানার, ফোল্ডার এবং কোস্টারের মতো মূল্য সংযোজিত পণ্যগুলি দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে জনপ্রিয়তা লাভ করেছে।
জিএসটি ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করার ফলে মাদুরকাঠি ম্যাট এবং এর বৈচিত্র্যপূর্ণ পণ্যগুলির দাম প্রায় ৬.২৫% কম হবে। এটি শিল্পীদের আয়ে একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বৃদ্ধি করবে এবং সেই সঙ্গে গ্রাহকের চাহিদা বাড়াতে সাহায্য করবে।
পুরুলিয়ার ছৌ মুখোশ
পুরুলিয়া জেলার চড়িদা গ্রামের প্রাণবন্ত ছৌ নাচের মুখোশগুলি তৈরি করেন স্থানীয় কারিগর সম্প্রদায়। চড়িদার ৩১০টি পরিবারের প্রায় ৫০০ জন মানুষ সরাসরি এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত, এবং এই গ্রামের ৮৫% শিল্পী এটিকে তাদের প্রধান জীবিকা হিসেবে ব্যবহার করেন। এই মুখোশগুলি পুরুলিয়া ছৌ নাচের ঐতিহ্যের মূল ভিত্তি এবং সাজসজ্জার শিল্পকর্ম হিসেবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারেও ব্যাপকভাবে বিক্রি হয়।
১২% থেকে কমিয়ে ৫% করা নতুন জিএসটির হার এই শিল্পের সাশ্রয়ী ক্ষমতা ও প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে দাম ৬.২৫% কমে আসবে, যা সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক উভয় দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, ৪,০০০ টাকা মূল্যের একটি মুখোশের উপর, ক্রেতারা এখন কর বাবদ প্রায় ২৫০ টাকা সাশ্রয় করবেন। নাচের দলগুলির জন্য, এটি অলঙ্কৃত মুখোশ সংগ্রহ করাকে আরও সহজ করে তুলবে। এই কম খরচ ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প সামগ্রীর সহজলভ্যতা ও চাহিদা বাড়াবে। রপ্তানি বাজারে, যেখানে যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স এবং জাপানের মতো দেশগুলিতে এই মুখোশগুলি প্রদর্শিত হয়, সেখানে জিএসটি হ্রাস শিল্পীদের লাভের পরিধি এবং আন্তর্জাতিক স্তরে প্রতিযোগিতা ক্ষমতা বৃদ্ধি করবে।
সুতরাং, এই কর ছাড় শুধু ১৫০ বছরের পুরোনো একটি ঐতিহ্যকেই রক্ষা করছে না, বরং এটি চড়িদা গ্রামের জীবিকাকেও সুরক্ষিত করছে, যা সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং গ্রামীণ আয় - উভয়কেই শক্তিশালী করছে।
কুশমণ্ডির কাঠের মুখোশ
দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুশমণ্ডি ব্লক, বিশেষত মহিষবাথান গ্রামে, কাঠের মুখোশ তৈরির শিল্পটি শতাব্দী প্রাচীন। প্রধানত স্থানীয় সম্প্রদায়ের সাথে যুক্ত এই শিল্পটি গোমিরা নাচের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, যেখানে শিল্পীরা মুখোশ তৈরি করাকে ভক্তির কাজ হিসাবে দেখেন। প্রায় ২৫০ থেকে ৩০০ জন শিল্পী সক্রিয়ভাবে এই কাঠের মুখোশ তৈরির কাজে নিযুক্ত। এই শিল্প এই পরিবারগুলির জন্য অতিরিক্ত আয় এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।
জিএসটির হার ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করার ফলে এই সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য বাস্তবিক অর্থে স্বস্তি এসেছে। এই হ্রাসের অর্থ হল মূল্য প্রায় ৬.২৫% কম হবে, যার মানে ৫,০০০ টাকা মূল্যের একটি মুখোশে কর বাবদ ৩১২ টাকা সাশ্রয় হবে। শিল্পীদের জন্য, এটি মেলাতে এবং অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে সরাসরি বিক্রয়কে আরও লাভজনক করে তুলবে।
লাভের প্রান্তরেখা বৃদ্ধি এবং সাশ্রয় ক্ষমতা উন্নত হওয়ার কারণে, জিএসটি সংস্কার শিল্পীদের তাদের শিল্প টিকিয়ে রাখার সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। এটি নিশ্চিত করছে যে এই ৩০০ বছরের পুরোনো কাঠের মুখোশ তৈরি করার ঐতিহ্য সাংস্কৃতিক দিক থেকে প্রাণবন্ত থাকার পাশাপাশি, অর্থনৈতিকভাবেও টিকে থাকবে ।
শোলার শিল্পকলা
শোলার শিল্পকলা বাংলার অন্যতম সূক্ষ্ম এবং পবিত্র শিল্প ঐতিহ্য, যা বর্ধমান, মুর্শিদাবাদ, বীরভূম, নদীয়া, হুগলি, মালদা এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলা জুড়ে প্রায় ৫,০০০ জন শিল্পী দ্বারা পরিচালিত হয়। ঐতিহ্যগতভাবে, শোলার মালা দেবতা ও অভিজাতদের উৎসর্গ করা হত। বর্তমানে এটি বাংলার সাংস্কৃতিক আচার-অনুষ্ঠানের, প্রধানত দুর্গাপূজা ও বিবাহ অনুষ্ঠানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। পশ্চিমবঙ্গের আনুমানিক ৫,০০০ জন শিল্পী এই শিল্পের সাথে যুক্ত, যেখানে কারিগররা সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম তৈরির জন্য মাসের পর মাস সময় ব্যয় করেন।
জিএসটি ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করার ফলে এই শ্রম-নিবিড় শিল্পকলার প্রতিযোগিতা ক্ষমতা সরাসরি বৃদ্ধি পাবে। সংশোধিত এই হারটির কারণে খরচ ৬.২৫% হ্রাস পাবে, অর্থাৎ ২,৫০০ টাকা মূল্যের একটি সাজসজ্জার পণ্যের দাম এখন প্রায় ১৫৬ টাকা কম হবে। এমন একটি বাজারে এই খরচ কমার সুবিধা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে শিল্পীরা মূলত দক্ষ শ্রমের উপর নির্ভরশীল। দাম কমার কারণে এই পরিবেশবান্ধব ও ঐতিহ্যবাহী পণ্যগুলি প্লাস্টিক বা থার্মোকলের সাজসজ্জার পণ্যের বিরুদ্ধে আরও বেশি প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে।
দেশীয় ও রপ্তানি বাজার - উভয় ক্ষেত্রেই এই কর ছাড় চাহিদা বৃদ্ধি করবে এবং লাভজনক উন্নতি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। খরচ কমানো এবং বাজারের প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে এই সংস্কারটি এমন একটি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে, যা প্রায়শই বাংলার ভেষজ গজদন্ত নামে পরিচিত।
শান্তিনিকেতনের চর্মশিল্প
বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতন-বোলপুর অঞ্চল এবং পার্শ্ববর্তী সুরুুল ও বল্লভপুরের মতো গ্রামগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শান্তিনিকেতন চর্মশিল্প দীর্ঘদিন ধরে ট্যান করা চামড়ার উপর হাতে-খোদাই করা বাটিক এবং অ্যাপ্লিকের নকশার জন্য বিখ্যাত। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রামীণ উন্নয়ন কর্মসূচির গভীরে থাকা এই শিল্পটি, যেখানে বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত, সেই অঞ্চলগুলিতে জীবিকার এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে কাজ করে। শিল্পটি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগের একটি বিতরণ কেন্দ্র দ্বারা চিহ্নিত, যা শত শত শিল্পীকে সরাসরি কর্মসংস্থান প্রদান করে। কলকাতা এবং তার আশেপাশে থাকা বৃহত্তর চর্মশিল্প ক্লাস্টারটি প্রায় ৫ লক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান যোগায়।
এই পণ্যগুলির দেশীয় বাজার বেশ প্রাণবন্ত, যেখানে বুটিক, এম্পোরিয়াম এবং জিআই কেন্দ্রিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম যেমন GiTAGGED and GIHeritage - এর মাধ্যমে পণ্য বিক্রি হয়। ছোট উদ্যোগগুলির বার্ষিক লেনদেন ৫০ লক্ষ টাকা থেকে ২.৫ কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে, যা এই ক্ষেত্রের অর্থনৈতিক গুরুত্ব তুলে ধরে। আন্তর্জাতিকভাবে, এই চর্মশিল্পের পণ্যগুলির চাহিদা জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপে রয়েছে, যেখানে ক্রেতারা গণ-উৎপাদিত বিকল্পগুলির চেয়ে এর স্বকীয়তা বা মৌলিকত্বের বেশি কদর করেন।
জিএসটির হার ১২% থেকে কমিয়ে ৫% করার ফলে দামে সরাসরি প্রায় ৬.২৫% কমে যাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ২,০০০ টাকা মূল্যের একটি হ্যান্ডব্যাগে গ্রাহকের এখন ১২৫ টাকা সাশ্রয় হবে। শিল্পীদের দ্বারা পরিচালিত ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ গুলির জন্য, এই কর ছাড় কৃত্রিম পণ্যের বিরুদ্ধে প্রতিযোগিতা ক্ষমতা বাড়াবে, লাভের মার্জিন উন্নত করবে এবং নকশা, গুণমান ও বিপণনে পুনর্বিনিয়োগের সুযোগ দেবে। গ্রাহকদের জন্য খরচ কমিয়ে এবং উৎপাদকদের লাভজনকতা বাড়িয়ে এই সংস্কার গ্রামীণ জীবিকাগুলিকে শক্তিশালী করছে এবং আন্তর্জাতিক বাজারে শান্তিনিকেতন চর্মশিল্পের অনন্য পরিচয় রক্ষায় সহায়তা করছে।
উপসংহার
ঐতিহ্যবাহী শিল্পের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের সমৃদ্ধ ইতিহাস নতুন জিএসটি ব্যবস্থার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হতে চলেছে। শান্তিনিকেতনের চর্মশিল্প থেকে মালদার আম-জাত পণ্য পর্যন্ত বিভিন্ন সামগ্রীতে সংশোধিত করের হার নির্ধারণের মাধ্যমে সরকার একদিকে যেমন গ্রাহকদের জন্য সাশ্রয়ী ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়েছে, তেমনই অন্যদিকে শিল্পীদের লাভের মার্জিন উন্নত করার উদ্দেশ্যও রেখেছে। এর ফলে উৎসবের মরসুমে এবং তারপরও বিক্রয় বৃদ্ধি পাবে, কর্মসংস্থান বজায় থাকবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতিতে গতি আসবে।
আরও গুরুত্বপূর্ণ হল, এই পরিবর্তনগুলি গ্রামীণ পরিবারগুলির জন্য একটি আশার আলো নিয়ে এসেছে; যা শত শত বছরের পুরোনো ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে উৎসাহিত করবে এবং একই সঙ্গে সেগুলিকে আধুনিক বাজারের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
---------------
হিন্দুস্থান সমাচার / ফারজানা পারভিন