মণিপুরে শান্তি স্থাপনে সম্মিলিত প্রচেষ্টা, ধৈর্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলার প্রয়োজন, বলেছেন ডা. ভাগবত
- ‘সমাজে শান্তি ফেরাতে সংঘ-কার্যকর্তারা অবিরাম কাজ করছেন’, নাগরিকদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান - ‘সরকারের কাছে সবকিছু আশা করা যায় না, নাগরিকদের দায়বদ্ধতা বাধ্যতামূলক’ ইমফল, ২০ নভেম্বর (হি.স.) : ধ্বংস হতে কয়েক মিনিট সময় লাগে, কিন্তু নির্মাণ করতে কয়েক
‘প্ৰবুদ্ধ নাগরিক সম্মেলন’-এ বৌদ্ধিক পেশ করছেন আরএসএস-এর সরসংঘচালক ডা. মোহন ভাগবত


‘প্ৰবুদ্ধ নাগরিক সম্মেলন’-এর মঞ্চে সরসংঘচালক


প্ৰবুদ্ধ নাগরিকদের একাংশ


- ‘সমাজে শান্তি ফেরাতে সংঘ-কার্যকর্তারা অবিরাম কাজ করছেন’, নাগরিকদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান

- ‘সরকারের কাছে সবকিছু আশা করা যায় না, নাগরিকদের দায়বদ্ধতা বাধ্যতামূলক’

ইমফল, ২০ নভেম্বর (হি.স.) : ধ্বংস হতে কয়েক মিনিট সময় লাগে, কিন্তু নির্মাণ করতে কয়েক বছর কিংবা কয়েক দশক লাগে। তাই মণিপুরে শান্তি স্থাপন করতে সম্মিলিত প্রচেষ্টা, ধৈর্য এবং সামাজিক শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে, বলেছেন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস)-এর সরসংঘচালক ডা. মোহন ভাগবত।

ত্রিদিবসীয় সফরের কার্যসূচি নিয়ে আজ বৃহস্পতিবার ইমফল এসেছেন আরএসএস-এর সরসংঘচালক ডা. মোহন ভাগবত। আজ কার্যসূচির প্রথমদিন তিনি ইমফলের কনজেং লেইকাইতে রাষ্ট্ৰীয় স্বয়ংসেবক সংঘের শতবৰ্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে নির্বাচিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবৰ্গ, পত্র-পত্রিকা সহ বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের সম্পাদক ও প্রবন্ধকার, শিল্পপতিদের উপস্থিতিতে আয়োজিত ‘প্ৰবুদ্ধ নাগরিক সম্মেলন’-এ বৌদ্ধিক পেশের পাশাপাশি মতবিনিময় করেছেন।

মতবিনিময় অনুষ্ঠানে রাজ্যে চলমান সহিংসতা সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে উল্লিখিত কথা বলেন ডা. ভাগবত। তিনি বলেন, ‘গত তিন বছর থেকে সংঘর্ষপীড়িত মণিপুরে শান্তি ফেরাতে সংঘ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে। কেননা, সংঘের কাজ মানুষের মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতির বতাবরণ সৃষ্টি করা। সরকার তার মতো কাজ করছে, আর সংঘও তার মতো করে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এর জন্য আপনাদেরও (স্থানীয় নাগরিক, বুদ্ধিজীবী প্রমুখ) করণীয় বহু কাজ আছে। রাজ্যে শান্তি ফেরাতে সংঘ-কার্যকর্তারা অবিরাম কাজ করছেন। তাঁদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আপনারাও এগিয়ে আসুন।’

প্ৰদত্ত বক্তব্যে সংঘের সভ্যতাগত ভূমিকা, জাতীয় দায়িত্ব এবং একটি শান্তিপূর্ণ ও শক্তিশালী মণিপুরের জন্য চলমান প্রচেষ্টা সম্পর্কে এভাবেই বিস্তারিতভাবে তাঁর মতামত তুলে ধরেছেন সরসংঘচালক।

ডা. ভাগবত বলেন, দেশে আজও আরএসএস আলোচনার বিষয়। কল্পিত ধারণা তথা উদ্দেশ্যপ্ৰণোদিত অপপ্ৰচারের ভিত্তিতে রাষ্ট্ৰীয় স্বয়ংসেবক সংঘ সম্পর্কে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, সংঘের বিরুদ্ধে অপপ্রচার শুরু হয়েছিল ১৯৩২-৩৩ সালের দিকে, বিশেষ করে বাইরের উৎস থেকে যাঁরা ভারত এবং এর সভ্যতাগত আত্মা বুঝতে অক্ষম ছিল। তাই সংঘকে উপলব্ধির ভিত্তিতে নয়, বাস্তবতার ভিত্তিতে বোঝা উচিত। রাষ্ট্ৰীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে জানতে হলে একেবারে ভেতরে ঢুকে পর্যবেক্ষণ-নিরীক্ষণ করা আবশ্যক। সংঘের নীতি-আদৰ্শ এবং কৰ্মকাণ্ডের পাশাপাশি সংঘকে নিয়ে চলমান চৰ্চা সম্পর্কে এ ভাবে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূৰ্ণ বক্তব্য পেশ করে ডা. ভাগবত সংঘকে বুঝতে হলে সংঘের দৈনন্দিন শাখায় যাওয়ার আহ্বান জানান।

ডা. ভাগবত বলেন, রাষ্ট্ৰীয় স্বয়ংসেবক সংঘ সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সংঘের কাজকে অতুলনীয় বলে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ‘সমুদ্র, আকাশ এবং মহাসাগরের মধ্যে কোনও যেমন তুলনা নেই, একইভাবে আরএসএস-এরও বিকল্প নেই।’ তিনি বলেন, সংঘের বিকাশ সম্পূর্ণরূপে অর্গানিক। প্রতিষ্ঠার ১৪ বছর পর সংঘের কার্যক্রম চূড়ান্ত করা হয়েছিল।

প্ৰসঙ্গক্ৰমে তিনি আরএসএস-এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পৰ্কে নানা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি বলেন, আরএসএস হলো সমগ্র হিন্দু সমাজকে সংগঠিত করা, এমন-কি যাঁরা সংঘের বিরোধিতা করেন তাঁদেরও সংগঠিত করা। সংঘ হলো প্ৰকৃত মানুষ তৈরির ব্যবস্থা। এর জন্য অবশ্যই সমাজে আলাদা শক্তি কেন্দ্র তৈরি করা নয়।

সংঘের প্রতিষ্ঠাতা তথা প্রথম সরসংঘচালক ডা. কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের জীবনাদর্শ স্মরণ করে তাঁর শিক্ষাগত দক্ষতা, সহজাত দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত প্রধান ধারায় ডাক্তারজির সক্রিয় ভূমিকার প্রসঙ্গও আজকের প্রবুদ্ধ নাগরিক সম্মেলনে তুলে ধরেছেন মোহন ভাগবত।

তিনি বলেন, ডা. হেডগেওয়ারের ঐক্যবদ্ধ এবং গুণগতভাবে সক্ষম সমাজের প্রয়োজনীয়তার উপলব্ধিই সংঘ তৈরির ভিত্তি হয়ে উঠেছিল।

প্রসঙ্গক্রমে তিনি স্পষ্ট করেছেন, ‘হিন্দু’ শব্দটি কোনও ধর্মীয় পরিচয়কে বোঝায় না, এই শব্দটি সাংস্কৃতিক এবং সভ্যতাগত বিশেষণ। একটি শক্তিশালী দেশের জন্য গুণ ও ঐক্য অপরিহার্য। দেশের অগ্রগতি শুধু নেতাদের ওপর নয়, সংগঠিত সমাজের ওপর নির্ভর করে। হিন্দু ভাবধারার অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘একম সদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি’। অৰ্থাৎ, ‘সত্য একটাই, জ্ঞানীরা একে বিভিন্ন নামে ডাকেন’। ‘সত্য, করুণা, বিশুদ্ধতা এবং তপস্যা - এগুলিই ধর্মের মৌলিক বিষয় এবং এগুলিই আমাদের হিন্দু সভ্যতার প্রাণ।’ তিনি বলেন, ‘বৈচিত্র্য কোনও মিথ নয়। বৈচিত্র্য হলো সমাজের অন্তর্নিহিত ঐক্যের বহিঃপ্রকাশ।’

ভারতের প্রাচীন জাতীয়তাবাদের কথা বলতে গিয়ে সরসংঘচালক বলেন, আমাদের দেশ পশ্চিমী রাষ্ট্র-ব্যবস্থা থেকে নয়, ঋষিদের তপস্যা, ত্যাগ ও বিশ্ব কল্যাণের দর্শন থেকে উদয় হয়েছে। বাসুধৈব কুটুম্বকমের মতো নীতিগুলি হিন্দুত্বের বৈশ্বিক দৃষ্টিকে প্রতিফলিত করে।

সম্বন্ধ সম্প্রসারণের ওপর জোর দিয়ে ডা. ভাগবত বলেন, ‘সমাজের শক্তি যখন বৃদ্ধি পায়, তখন বিশ্ব তার কথা শোনে। দুর্বলের কথা কেউ শোনে না। সংঘের উদ্দেশ্য হলো একটি সক্ষম, সতর্ক ও সংগঠিত হিন্দু সমাজ তৈরি করা।’ তিনি বলেন, সংঘ নিজের খ্যাতি বা গৌরবের জন্য কাজ করে না, ‘তোমার মহিমা চিরকাল থাকুক মা, আমরা চারদিন বাঁচি বা না-থাকি।’ এ ধরনের নিবেদিতপ্রাণ কার্যকর্তারা আমাদের গুরুদের কল্পিত ‘নায়ক’।

বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে তিনি সংঘের শতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে গৃহীত ‘পঞ্চ পরিবর্তন’-এর কথা উল্লেখ করেছেন। ডা. ভাগবত সমাজে ‘পঞ্চ পরিবর্তন’, অৰ্থাৎ পাঁচটি পরিবর্তন যেমন ‘সামাজিক সমরসতা’ (সামাজিক সম্প্রীতি), ‘কুটুম্ব প্ৰবোধন’ (পারিবারিক জাগরণ), ‘নাগরিক কর্তব্য’, স্বদেশী ও স্বনির্ভরতা’ এবং ‘পরিবেশ সংরক্ষণ’-এর ব্যাখ্যা করেছেন।

তিনি মণিপুরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, বিশেষ অনুষ্ঠানে ঐতিহ্যবাহী পোশাক এবং স্থানীয় ভাষা ব্যবহারের প্রশংসা করে এগুলো আরও জোরদার করার আহ্বান জানিয়েছেন।

মণিপুরের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে সংঘ-প্রধান বলেন, ‘স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারের জন্য সমাজ এবং সম্প্রদায়ের স্তরে সংঘের প্রচেষ্টা চলছে। ধ্বংস হতে কয়েক মিনিট সময় লাগে, কিন্তু সৃষ্টিতে কয়েক বছর কিংবা কয়েক দশক লাগে। তাই মণিপুরে শান্তি স্থাপন করতে প্ৰয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা, ধৈর্য এবং এবং সামাজিক শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে,’ বলেছেন সরসংঘচালক। তিনি বলেন, ‘জনসচেতনতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকারের কাছে সবকিছু আশা করা যায় না। সমাজের প্রতি নাগরিকদের দায়বদ্ধতা বাধ্যতামূলক। একটি স্বনির্ভর ভারতের জন্য, আমাদের সমাজকেও স্বনির্ভর হতে হবে। সংঘ সবসময় শক্তিশালী সামাজিক পুঁজির ওপর জোর দেয়’, বলেন তিনি।

অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের জন্য দক্ষতা উন্নয়নের ওপরও জোর দিয়েছেন ডা. ভাগবত। বক্তব্যের শেষে তিনি সংঘের আদর্শের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। বলেন, ‘সম্পূর্ণ সমাজের সংগঠন হয় সজ্জন শক্তির মাধ্যমে।’

হিন্দুস্থান সমাচার / সমীপ কুমার দাস




 

 rajesh pande