জুবিন গাৰ্গকে মেরেছে একজন, সহায়তা করেছে অন্যরা, বিধানসভায় দাবি মুখ্যমন্ত্ৰী হিমন্তের
৮ ডিসেম্বর দাখিল হবে চাৰ্জশিট, তদন্ত চলবে আনুষঙ্গিক বিষয়েও মুখ্যমন্ত্ৰীর ভাষণে বাধা, স্পিকারের আসনের সামনে উচ্ছৃঙ্খলপনা, বহিষ্কৃত বিধায়ক অখিল ৮৩-এর রক্তাক্ত নেলি হত্যাকাণ্ডের তিওয়ারি কমিশনের প্ৰতিবেদন পেশ মুখ্যমন্ত্ৰীর গুয়াহাটি, ২৫ নভেম্বর (হি.স
বিধানসভায় বক্তব্য পেশ করছেন মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্তবিশ্ব শর্মা


৮ ডিসেম্বর দাখিল হবে চাৰ্জশিট, তদন্ত চলবে আনুষঙ্গিক বিষয়েও

মুখ্যমন্ত্ৰীর ভাষণে বাধা, স্পিকারের আসনের সামনে উচ্ছৃঙ্খলপনা, বহিষ্কৃত বিধায়ক অখিল

৮৩-এর রক্তাক্ত নেলি হত্যাকাণ্ডের তিওয়ারি কমিশনের প্ৰতিবেদন পেশ মুখ্যমন্ত্ৰীর

গুয়াহাটি, ২৫ নভেম্বর (হি.স.) : জুবিন গাৰ্গের মৃত্যু-রহস্য উদ্ঘাটন সহ প্ৰাণের শিল্পীকে ন্যায় দিতে অসম সহ দেশ-বিদেশের প্রত্যেক জুবিনপ্ৰেমী দাবি করছেন। এমতাবস্থায় সম্প্রতি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্তবিশ্ব শর্মা বলেছেন, ‘এতদিন আমরা জুবিনের মৃত্যুকে একটি দুর্ঘটনা বলে মনে করেছিলাম, কিন্তু এখন বলছি জুবিনের মৃত্যু দুর্ঘটনায় নয়, অসমের হৃদস্পন্দনকে হত্যা করা হয়েছে।’ এর পর থেকে মুখ্যমন্ত্ৰীর ওই দাবিকে কটাক্ষ করে চলেছেন বিরোধীরা। তাঁদের বক্তব্য, জুবিন গাৰ্গকে হত্যা করা হয়েছে বলে মুখ্যমন্ত্ৰী কীভাবে নিশ্চিত হয়েছেন? তাঁর হাতে কী প্রমাণ বা তথ্য আছে? আজ মঙ্গলবার অসম বিধানসভার শীতকালীন অধিবেশনের প্ৰথম দিন এই একই প্রশ্ন তুলেন বিরোধীরা। বিরোধীদের যাবতীয় প্রশ্নের জবাব পুঙ্খানুপুঙ্খ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী ড. শর্মা।

আজ শীতকালীন অধিবেশনের প্ৰথম দিন বিরোধী দলনেতা দেবব্ৰত শইকিয়া সদন স্থগিত প্ৰস্তাব এনে জুবিন গাৰ্গের মৃত্যু সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর চৰ্চা করার দাবি জানান। তাঁর দাবি শাসকপক্ষ মেনে নেওয়ায় জুবিন গাৰ্গের হত্যা সম্পর্কিত বিষয়ের ওপর চর্চা শুরু হয়। বিরোধী দলের বিধায়করা নিজ নিজ বক্তব্য পেশ করে জানতে চান, কীসের ভিত্তিতে জুবিন গার্গকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করছেন মুখ্যমন্ত্ৰী?

সবার বক্তব্য শেষ হলে ওঠে দাঁড়ান মুখ্যমন্ত্ৰী। বিধানসভার বাইরে প্রদত্ত বয়ানে অটল মুখ্যমন্ত্রী এবার বিধানসভার ভিতরেও বেশ জোরের সঙ্গে বলেন, ‘আমার কাছে যথেষ্ট তথ্য আছে, জুবিন গাৰ্গের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। আমাদের প্ৰাণের শিল্পীকে হত্যা করা হয়েছে। একজন তাঁকে মেরেছে এবং বাকিরা হত্যায় সহায়তা করেছে। মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, আগামী ৮ বা ১০ ডিসেম্বর জুবিন গাৰ্গের রহস্যমৃত্যু তথা হত্যার তদন্তকারী এসআইটি আদালতে চাৰ্জশিট দাখিল করবে।’

ড. শর্মা বলেন, ‘সংসদীয় পরম্পরায় সচরাচর দেখা যায়, বিরোধীদের আনিত সভা স্থগিত প্ৰস্তাবের বিরোধিতা করে সরকার পক্ষ। কিন্তু আজ বিষয়টি যেহেতু অসমিয়াদের হৃদস্পন্দন প্ৰাণের শিল্পী জুবিন গাৰ্গকে নিয়ে, তাই তাঁকে শ্ৰদ্ধাঞ্জলি অর্পণের জন্য এই বিষয়ের ওপর চৰ্চা হওয়া দরকার।’ তিনি বলেন, ‘জুবিন গাৰ্গ অসমের সম্পদ বলে জীবিতকালে একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সম্মাননা প্রদান অনুষ্ঠানে তাঁর সামনে বলেছিলাম। তাঁকে রাজনীতির বাইরে রাখার আহ্বানও সেদিন জানিয়েছিলাম। এর পর জুবিন গাৰ্গ বক্তব্য পেশ করতে গিয়ে আমার উদ্দেশ্যে বলেছিল, তাঁকে আমি মুখ্যমন্ত্ৰী নয়, দাদা হিসেবে সম্বোধন করি। অতএব জুবিনের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোন পর্যায়ে ছিল, তা আর ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না।’

মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, ‘জুবিন গাৰ্গের মৃত্যুর পর যেদিন মামলা রুজু হয়েছিল, সেদিন থেকেই তা স্পষ্ট, এটা দুর্ঘটনা নয়, হত্যাকাণ্ডের মামলা। সে অনুযায়ী বিএনএস-এর ১০৩ সহ বিভিন্ন ধারা রুজু করা হয়েছে। প্ৰারম্ভিক পৰ্যায়ের তদন্তে স্পষ্ট হয়েছে, এটা কোনও স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে না। ১০৩ ধারা সংযোজন না করলে সিদ্ধাৰ্থ শৰ্মা বা অন্যরা দুমাসের মধ্যেই রেহাই পেয়ে যেতেন।’

তিনি বলেন, ‘বিরোধীদের হাতে কোনও তথ্য নেই। আজ পর্যন্ত যারা জেলে, তারা সবাই হত্যা-মামলায় অভিযুক্ত। ফলে কোনও সন্দেহ নেই, এটা এক হত্যাকাণ্ড।’ জোরের সঙ্গে বলেন মুখ্যমন্ত্রী।

মুখ্যমন্ত্ৰী আজ বিধানসভায়ও বরাবরের মতো বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের পর জুবিনের দ্বিতীয় ময়না তদন্ত করার ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু বহুজন দাবি করেছিলেন, দ্বিতীয়বার ময়না তদন্ত করতে। তাই তাঁদের দাবির ভিত্তিতে গৌহাটি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং এইমস্ গুয়াহাটিতে দ্বিতীয় ময়না তদন্ত সম্পন্ন করে ৩ অক্টোবর তার রিপোর্ট পেয়েছিলাম। ১০ অক্টোবর হাতে আসে ভিসেরা রিপোৰ্ট। সিঙ্গাপুর এবং এখানকার সব রিপোৰ্ট আমরা পেয়েছি ৫ নভেম্বর। জুবিন গাৰ্গের হত্যার মোটিভ দেখে ২৫২ জনের সাক্ষ্যবাক্য গ্ৰহণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত আমরা সাতজনকে গ্ৰেফতার করেছি। ১০ জন এনআরআই-এর কাছ থেকে প্ৰয়োজনীয় ভিডিও বাজেয়াপ্ত করেছি আমরা। ভারতীয় নাগরিক সংহিতায় বলা হয়েছে, বিদেশে সংঘটিত ঘটনা ভারতে তদন্ত করা যাবে। তবে এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অনুমতি প্রয়োজন। জুবিনকে হত্যা করা হয়েছে বলে আমরা ভারত সরকারকে অবগত করেছি।’

ড. শর্মা বলেন, ‘এই মামলা ফাস্টট্ৰ্যাক আদালতে চলবে, মামলার ফলাফল নিৰ্বাচনের আগে ঘোষণা হতে পার। চাৰ্জশিট দাখিলের পর আমরা উচ্চ আদালতের কাছে মামলাটি ফাস্টট্ৰ্যাক কোৰ্টে দিতে আবেদন জানাব। আমরা বিচার-ব্যবস্থাকে সন্দেহ করি না, বিরোধীরা করছেন।’

চাঁছাছোলা ভাষায় বিরোধীদের উদ্দেশ্যে মুখ্যমন্ত্ৰী ফের বলেন, ‘জুবিনকে মেরছে একজন, অন্য কয়েকজন সহযোগিতা করেছে। হত্যাকে হত্যা না বলে কি চুমা খেয়েছে বলব? এই তদন্ত শেষ হওয়ার পর আমি আরও একটা তদন্ত করতে এসআইটিকে নিৰ্দেশ দিয়েছি। তা হলো, কোভিড-এর সময়কালে জুবিনকে অবহেলা করা হয়েছিল। তার প্ৰমাণ আমাদের হাতে আছে। জীবিতকালে জুবিনের সঙ্গে যে বা যারা অন্যায় করেছেন, তাদের একজনও রেহাই পাবেন না। ক্ৰিমিনালদের সঙ্গে গেম খেলতে হবে আমাদের। আমি গেম খেলেছি বলেই পুলিশের জালে উঠেছে ক্ৰিমিনালরা। এরা আজও জেলে আছে। তিন মাসের মাথায় চাৰ্জশিট না হলে এরা জামিন পেয়ে যাবে। আমরা চাৰ্জশিট দিলে অসমের জনগণ বহু কথা জানতে পারবেন। সে জন্য বিহু কমিটিকেও ডাকা হয়েছে।’

মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, ‘পলিটিক্স নকরিবা বন্ধু...’ স্বরচিত গানটি জুবিন গাৰ্গ গেয়েছিলেন অখিল গগৈ (বামপন্থী নির্দলীয় বিধায়ক)-কে উদ্দেশ্য করে। কারণ ‘নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন’ (সিএএ)-এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে দল গঠন করে রাজনীতির ময়দানে এসেছিলেন অখিল গগৈ। গানটি বিজেপির বিরুদ্ধে নয়। বরং বিজেপির পক্ষে জুবিন গেয়েছিলেন ‘অসমর আনন্দ সৰ্বানন্দ...’ (অসমের আনন্দ সর্বানন্দ, সর্বানন্দ সনোয়াল অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্তমান কেন্দ্রীয় মন্ত্রী)।

এদিকে, জুবিন গাৰ্গকে ভারতরত্ন প্ৰদান করা উচিত বলে মুখ্যমন্ত্ৰীকে প্ৰস্তাব উত্থাপন করতে অনুরোধ করেন অখিল গগৈ। অখিলের অনুরোধের প্ৰত্যুত্তরে মুখ্যমন্ত্ৰী বলেন, ‘ভারত রত্ন দিতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। ভূপেন হাজরিকার মতো ভালোবাসা দিয়ে প্ৰস্তাব আনতে হবে। এ বিষয়ে একদিন সদনে আলোচনা করতে হবে। কেবল অখিল গগৈই নন, এই বিধানসভার ১২৬ জন সদস্যই জুবিন গাৰ্গকে ভারত রত্ন দেওয়ার পক্ষে স্বাক্ষর করবেন। কিন্তু এই প্ৰস্তাবটি সুন্দরভাবে উত্থাপন করে এক গঠনমূলক আলোচনা করে প্ৰাণের শিল্পীকে সম্মান জানিয়ে গ্ৰহণ করতে হবে। অখিল গগৈ সহ বিরোধীদের রাজনীতি করতে জুবিন গাৰ্গকে ব্যবহার করলে চলবে না।’

আজ সভা স্থগিত প্ৰস্তাবের চৰ্চায় অংশগ্ৰহণ করে বিরোধী দলপতি দেবব্ৰত শইকিয়া, সরভোগের বিধায়ক সিপিআইএম নেতা মনোরঞ্জন তালুকদার, কংগ্ৰেসের নন্দিতা দাস, কংগ্ৰেসের দিগন্ত বৰ্মণ, এআইইউডিএফ-এর আশ্ৰাফুল হুসেইন এবং শিবসাগরের নির্দলীয় বিধায়ক অখিল গগৈ নিজ নিজ বক্তব্যে সরকারের সমালোচনা করেছেন।

এদিকে শিবসাগরে বিধায়ক অখিল গগৈ মুখ্যমন্ত্ৰীর বক্তব্যের মধ্যে উচ্চৈঃস্বরে বারবার কথা বলার চেষ্টা করে সদনে এক হুলস্থুল পরিবেশের সৃষ্টি করেন। এক সময় তিনি অধ্যক্ষের আসনের সামনে গিয়ে হই-হট্টগোল করতে থাকলে সদন থেকে বহিষ্কার করেন স্পিকার বিশ্বজিত দৈমারি।

এছাড়া জুবিন গাৰ্গের মৃত্যু মামলার তদন্ত সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্ৰী বক্তব্যে অসন্তুষ্ট কংগ্ৰেস কিছুসময়ের জন্য বয়কট করেন সদন।

অন্যদিকে জুবিন গাৰ্গের মৃত্য-মামলা সম্পর্কিত বক্তব্যের পর সদনে ১৯৮৩-এর রক্তাক্ত নেলি হত্যাকাণ্ডের তিওয়ারি কমিশনের প্ৰতিবেদন পেশ করেছেন মুখ্যমন্ত্ৰী।

হিন্দুস্থান সমাচার / সমীপ কুমার দাস




 

 rajesh pande