কাশ্মীর-কাণ্ড মনে করিয়ে দিচ্ছে বামপন্থীদের ৬৩ বছর আগের মনোভাব
অশোক সেনগুপ্ত কলকাতা, ২৪ এপ্রিল (হি.স.): কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে বেছে বেছে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারতজুড়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতা আরও জাতীয়তাবাদী ও শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যবস্থার দাবি তুলেছেন। এর মধ্যে খানি
কাশ্মীর-কাণ্ড


অশোক সেনগুপ্ত

কলকাতা, ২৪ এপ্রিল (হি.স.): কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে বেছে বেছে পর্যটকদের ওপর বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারতজুড়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের নেতা আরও জাতীয়তাবাদী ও শক্তিশালী নিরাপত্তাব্যবস্থার দাবি তুলেছেন। এর মধ্যে খানিকটা স্রোতের বিপরীতে হাঁটছে বামপন্থীদের একটা বড় অংশ। সামাজিক মাধ্যমে তাদের প্রচারে স্মৃতিতে ভেসে উঠছে প্রায় ৬৩ বছর আগের কিছু ইতিহাস। চিন আক্রমণ করেছিল ভারতকে। সে সময় কী ভূমিকা ছিল কমিউনিস্টদের?

আগের প্রসঙ্গটায় পরে আসছি। প্রথমে দেখা যাক, পরিচিত বামপন্থীদের বর্তমান অবস্থান। আক্রমনকারীদের শায়েস্তা করার হুঁশিয়ারি নয়, তাঁদের কলম ধারালো হয়ে উঠেছে মোদী-শাহর সমালোচনায়। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেনীর ‘প্রথম আলো’ বৃহস্পতিবার বড় করে প্রকাশ করেছে পশ্চিমবঙ্গ সিপিআইএমের (কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মার্ক্সবাদী) সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের কথা।

ওই পত্রিকার সংবাদদাতা শুভজিৎ বাগচি লিখেছেন, “সেলিম সাধারণ মানুষকে সাবধান করেছেন, যাতে এই ঘটনাকে কাজে লাগিয়ে কোনো পক্ষ সাম্প্রদায়িক উসকানি ও বিভাজন বাড়াতে না পারে। কাশ্মীরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতে অনেকটা জাতীয়তাবাদের সুনামি তৈরির মধ্যে তাঁর এই মন্তব্যকে ভালোভাবে দেখেননি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীরা।”

আর এক নেতা সৃজন ভট্টাচার্য মঙ্গলবার রাতেই সামাজিক মাধ্যমে লিখেছেন, “কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা তুলে সন্ত্রাসবাদীদের একদম ঠাণ্ডা করে দিয়েছে বিজেপি সরকার! যারা এসব বলতো, তারা আজ দায়িত্ব নেবে না? জঙ্গিহানায় চলে গেল তরতাজা প্রাণ কতগুলো! একেবারে পহেলগাঁও! কাশ্মীরকে সন্ত্রাসীদের জন্য সুবিধাজনক করে দিয়েছে দিল্লির পলিসি! সন্ত্রাসবাদ রুখতে কাশ্মীরেরসাধারণ মানুষকে কাছে টানতে হয়! দূরে ঠেলতে নেই! বিজেপি তাই করেছে, করছে!”

বৃহস্পতিবার বেলা ১০টা পর্যন্ত সৃজনের এই মন্তব্যে সমর্থন ও বিরোধিতা করে ১ হাজার ১০০টি প্রতিক্রিয়া এসেছে। অন্যদিকে, ‘প্রথম আলো’-তে শুভজিৎ লিখেছেন, “মহম্মদ সেলিমের তীব্র সমালোচনা শুরু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে, বিশেষত ফেসবুকে।”

নেতৃবৃন্দের বাইরে ঘোষিত সিপিএম-দের মধ্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিটির সভানেত্রী মহালয়া চট্টোপাধ্যায় সামাজিক মাধ্যমে বড় হরফে লিখেছেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিলো?” বৃহস্পতিবার বেলা ১০টা পর্যন্ত তাতে নানা ধরণের ৫৬টি প্রতিক্রিয়া এসেছে। তমাল চৌধুরী লিখেছেন, “তাই বলে এখন এই প্রশ্নটা করাই সবচেয়ে জরুরী! যেভাবে এতগুলো প্রাণ চলে গেল তা নিয়ে একটু দুঃখ প্রকাশ করাও কি যায় না? বা যারা জাত দেখে দেখে গুলি করল তাদের নিয়ে দুয়েকটা মন্তব্য?” এতে মহালয়ার জবাব, “দু:খ প্রকাশ তো আগেই করেছি। কিন্তু আমার করের টাকার অপচয় হলে আমার প্রশ্ন করার অধিকার নেই?”

কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন ডিজি দীপঙ্কর সিংহ ফেসবুকে বড় হরফে লিখেছেন, “অনেক প্রাণের বিনিময়ে সম্প্রীতির বিরুদ্ধে, শান্তির বিরুদ্ধে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।” বৃহস্পতিবার বেলা ১০টা পর্যন্ত তাতে ৩০টি প্রতিক্রিয়া এসেছে। গৌরব মুখার্জি লিখেছেন, “'ইজরায়েল দাওয়াই'-এর তত্ত্ব সুকৌশলে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে!” মাসিহ সৈয়দ লিখেছেন, “এই দেশকে ইজরায়েল বানাতে চান মোদী, আর এস এস চক্র। সবাই মিলে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানাই।” আবার বিরোধিতাও করেছেন অনেকে। যেমন গৌতম দত্ত লিখেছেন, “আহা রে সোনাটা আমার, দুঃখ হচ্ছে?”

এবার ফিরে যাই ভারতের কমিউনিস্টদের অতীত ভাবধারায়। ১৯৫৯ সালের ২১শে অক্টোবর চিনা বাহিনীর হাতে ১০ জন ভারতীয় সিআরপিএফ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাটি ছিল শত্রুতার সূচনা। সেটি অবশেষে ১৯৬২ সালের চিন-ভারত যুদ্ধে পরিণত হয়। পূর্ব লাদাখের উঁচু পর্বতমালায়, কোংকা পাস নামে পরিচিত একটি শুষ্ক স্থানে সংঘটিত ঘটনাগুলি ছিল ভারতের জন্য এক বিরাট ধাক্কা। ভারত ও চিনের মধ্যে প্রধান বিরোধ ছিল দীর্ঘ সীমান্তের পশ্চিম ও পূর্ব প্রান্ত নিয়ে। চিন ভারতীয় ভূখণ্ডের মধ্যে দুটি এলাকা দাবি করে: জম্মু ও কাশ্মীরের লাদাখ অঞ্চলের আকসাই-চিন এলাকা এবং অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যের বেশিরভাগ অংশ যাকে তখন নেফা (নর্থ ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি) বলা হত। চিন ১৯৬২ সালের অক্টোবরে উভয় বিতর্কিত অঞ্চলে একটি দ্রুত এবং ব্যাপক আক্রমন শুরু করে।

চিনের যুদ্ধ দেশে ও বিদেশে ভারতের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছিল। চিনা অভিপ্রায় এবং সামরিক প্রস্তুতির অভাব সম্পর্কে তার নির্বোধ মূল্যায়নের জন্য কঠোরভাবে সমালোচিত হওয়ায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর নিজের মর্যাদা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। প্রথমবারের মতো, তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে একটি অনাস্থা প্রস্তাব আনা হয়। বিতর্ক হয়েছিল লোকসভায়। কিন্তু উদ্ভুত ঘটনায় তৎকালীন দেশের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই) -র মধ্যে ভাঙনের সূত্রপাত ঘটায়।

বিশিষ্ট ইঞ্জিনিয়র, চার্টার্ড ফাইনেন্সিয়াল অ্যানালিস্ট, জননীতি বিশ্লেষক এবং লেখক সুদীপ্ত গুহ এই প্রতিবেদককে জানান, “সন্ত্রাসবাদীরা যখন সত্য বলতে দ্বিধাগ্রস্ত, যখন তারা খুঁজে খুঁজে হিন্দুদের হত্যা করে ভারতকে জানালো যে তারা ইসলামিক মৌলবাদকে প্রতিষ্ঠার জন্যই ওই কাজ করেছে, তখন কেন বামেরা মুসলিম সন্ত্রাসবাদকে আড়াল করে গোল গোল বিবৃতি দিচ্ছে? কারন মূলত: দুটি— এক, পশ্চিমবঙ্গে ৩৪ বছর কুশাসনে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিল্প, সংস্কৃতি, পরিকাঠামো, নাগরিক পরিষেবা, কর্মসংস্কৃতি, সেচ, পরিবেশ, পর্যটন থেকে সবরকম সামাজিক ক্ষেত্রে চূড়ান্ত ব্যর্থ হবার পর তাঁদের মানুষকে কিছু দেবার নেই। তাই তাঁদের এমন কিছু ভোটদাতা দরকার, যারা এই বিষয়গুলোর বাইরে গিয়ে অন্য কোনও কারণে ভোট দেয়। এ ছাড়াও তাদের দরকার গুচ্ছ মুসলিম ভোট। যে খেলা মমতা ব্যানার্জি খেলছেন, সেই খেলায় জিততে চাইছে বামেরা।

সমাজমাধ্যম বুধবার থেকে স্পষ্টতই দুটি ভাগ। একটি ভাগ পহেলগাঁও নিয়ে ভারত সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে ব্যস্ত। আর একটি ভাগ স্পষ্টতই ভারত সরকারের পাশে। দু’পক্ষের বিতর্ক-যুক্তির ভিন্নতা, মাত্রা ও চর্চা প্রভাবিত করছে অনেককে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, ব্যবস্থাপনা-পরামর্শদাতা রূপেন্দ্রনারায়ণ রায় ২০০৩ থেকে এক যুগ ধরে ছিলেন প্রাইস ওয়াটারহাউস এবং ডিলয়েটস-এর মত আন্তর্জাতিক মানের সংস্থার ম্যানেজিং ডিরেক্টর। ইন্সটিট্যুট অফ চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টেস অফ ইন্ডিয়া এবং হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের প্রাক্তনী। এই পটভূমিতে তিনি সামাজিক মাধ্যমে বড় হরফে লিখেছেন, ”কমরেড সেলিম একটা পুরানো স্লোগান একটু বদলে দিলাম: তোমার নাম আমার নাম পহেলগাম পহেলগাম”।

পৃথক পোস্টে ভারতের জাতীয় পতাকার ছোট্ট ছবি ব্যবহার করে ব্যবসায়ী বৈশালী ডালমিয়া লিখেছেন, “Chak de India। We want Pakistan out of our system

Enough is Enough!” বৃহস্পতিবার সকাল সওয়া ছ’টায় প্রতিক্রিয়া এসেছে ৪২টি।

সৌহার্দ্য বিশ্বাস লিখেছেন, “পার্থক্য কোথায় জানেন? হিন্দুরা মর্মাহত, ক্ষিপ্ত, ক্রুদ্ধ………কিন্তু তাই বলে কোথাও কোনো নিরপরাধ মুসলমানের প্রাণ যাবে না।”

ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রাক্তন উইং কম্যান্ডার সামন্ত্যক দত্ত লিখেছেন, “ফেসবুক নানা ভদ্রলোকের শোক বার্তা প্রকাশ করছে।

কেউ কেউ খুব দুঃখ পাচ্ছেন কিন্তু বলছেন না যে হিন্দুদের মেরেছে। হিন্দু হত্যা কথাটা নেই।

এরা বেশিরভাগই মেরুদন্ডহীন লিবারেন্ডু।

নিজেকে তো হিন্দু বলেই না এমনকি হিন্দু মরেছে কথাটা বলতে ও ভয়। এদের ধ্বংস করা প্রথম লড়াই।” অপর একটি মন্তব্যে তিনি একটি বাংলা দৈনিককে উদ্দেশ করে লিখছেন, ওদের “একটাই উদ্দেশ্য। দেখাও যে মুসলমান কাশ্মীরিরা কেঁদে ভাসাচ্ছে। বাঙ্গালী বিশ্বাস করতে চায় না যে মোল্লারা হত্যাকারী।

আহা রে !! খুকি আমার!”

গোটা বিষয়টিতে সুদীপ্ত গুহ মার্ক্সবাদীদের দায়ী করেছেন ভুল জাতীয়তাবাদের সংজ্ঞার জন্য। তাঁর মতে, “সেটি তাঁদের দেশকে ভালোবাসতে শেখায় নি। এই ভুল প্রথম বোঝেন স্তালিন দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়। যখন জার্মানিরা উগ্র জাতীয়তাবাদের উপর নির্ভর করে সোভিয়েতকে আক্রমন করে, স্টালিনের লাল বাহিনী তখন চাকরি হিসেবে যুদ্ধটাকে নেয়। প্রথম দিকে পিছিয়ে আসে সোভিয়েত সেনা। পরে পরিস্থিতি তাঁদের জিততে সাহায্য করলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর স্তালিন নতুনভাবে জাতীয়তাবাদ সংজ্ঞা নির্ধারণ করেন। আজকের চিনের সেনাও সিসিপির সেনা, দেশের না। তাই চিন কারোর সঙ্গে যুদ্ধে যেতে চায় না সচরাচর। আমাদের সিপিএমেরও সেই একই সমস্যা। দেশ তার নিজের এটা ভাবতেই কষ্ট হয়। শুধু ক্ষমতাই লক্ষ্য। তাই হরসুন্দর, চন্দনের মত বিপদের দিনের কর্মীকেও ছেড়ে দিতে তারা দুবার ভাবে না”।

---------------

হিন্দুস্থান সমাচার / অশোক সেনগুপ্ত




 

 rajesh pande