

গুয়াহাটি, ২০ ডিসেম্বর (হি.স.) : ব্রহ্মপুত্রের মতো অসমে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হচ্ছে উন্নয়ন, চাকরিকে ‘পার্চি-খরচি’ (সুপারিশ ও ঘুষ)-তে পরিণত করেছিল কংগ্রেস সরকার, গুয়াহাটি বিমানবন্দর টার্মিনাল ভবন উদ্বোধন এবং অসমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ভারতরত্ন গোপীনাথ বরদলৈয়ের ৮০ ফুট উঁচু পূর্ণায়ব মূর্তি উন্মোচন করে আয়োজিত লক্ষাধিক আবালবৃদ্ধবনিতা তথা জনতার সমাবেশে বলেছেন প্রধানমন্ত্র্রী নরেন্দ্র মোদী।
আজ শনিবার বিকাল তিনটা নাগাদ লোকপ্রিয় গোপীনাথ বরদলৈ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অত্যাধুনিক নবনিৰ্মিত টার্মিনাল ভবনের উদ্বোধন এবং অসমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী ভারতরত্ন গোপীনাথ বরদলৈয়ের ৮০ ফুট উঁচু পূর্ণায়ব মূর্তির আবরণ উন্মোচন করে আয়োজিত সমবেশে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে উদাত্ত ভাষণ দিচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। নবনির্মিত টার্মিনাল ভবনকে তিনি অসমের উন্নয়নযাত্রার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে অভিহিত করেছেন।
সমাবেশে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিজেপির ‘ডাবল ইঞ্জিন সরকার’-এর অধীনে অসমে নিরবচ্ছিন্ন উন্নয়ন চলছে। রাজ্যের জীবনরেখা ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র নদ অসমে যেমন অবিরাম প্রবাহিত হয়, তেমনই এখানে উন্নয়নের ধারা নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রবাহিত হচ্ছে।’
মোদী বলেন, অসম তথা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে তাঁর গভীর আবেগপূর্ণ সম্পর্ক তাঁকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। তিনি বলেন, ‘অসমের মাটির সঙ্গে আমার টান, এখানকার মানুষের ভালোবাসা ও স্নেহ, বিশেষ করে অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মা-বোনদের ভালোবাসা আমাকে সর্বদা অনুপ্রাণিত করে। তাই এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য আমাদের সংকল্পকে আরও শক্তিশালী করে।’
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, নবনির্মিত টার্মিনাল ভবন উদ্বোধনের মাধ্যমে অসমের উন্নয়ন ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। এটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যটন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে উল্লেখযোগ্যভাবে এগিয়ে নিয়ে যাবে। নবনির্মিত টার্মিনাল ভবনের উদ্বোধনকে বৃহত্তর জাতীয় প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী একে উত্তর-পূর্বাঞ্চল জুড়ে অসমে উদযাপিত এক বৃহত্তর ‘বিকাশ কা উৎসব’-এর অংশ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতির আওতায় অসম ক্রমশ ভারতের পূর্বদ্বার হিসেবে উঠে আসছে। অসমে উৎপাদিত বাঁশ দিয়ে সমৃদ্ধ এই টার্মিনালটি শক্তি, টেকসই উন্নয়ন এবং ‘বিকশিত ভারত’-কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে রাজ্যের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার প্রতীক, যে সময়ে ভারত বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে পরিণত হওয়ার পথে অগ্রসর হচ্ছে, বলন প্ৰধানমন্ত্ৰী।
অত্যাধুনিকীকৃত এই টার্মিনালটি যাত্রী পরিবহণ সক্ষমতা বাড়াবে এবং ভ্রমণ পরিকাঠামো উন্নত করবে। ফলে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রবেশদ্বার হিসেবে গুয়াহাটির ভূমিকা আরও মজবুত হবে, বলেন মোদী।
প্রধানমন্ত্রী মোদী আজ তদানীন্তন কংগ্রেস সরকারের তুলোধোনা করেছেন। বলেন, কংগ্রেস সরকার চাকরিকে ‘পার্চি-খরচি’তে পরিণত করেছিল। এখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকারের আমলে দুর্নীতিমুক্ত মেধার ভিত্তিতে পার্চি-খরচি ছাড়া হাজার হাজার যুবক-যুবতী সরকারি চাকরি পাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন।
বিশাল জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণ শানিয়ে নরেন্দ্ৰ মোদী বলেন, যে গোপীনাথ বরদলৈ অসমকে রক্ষা করেছিলেন, সেই মহান ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মান দেয়নি তাঁর দল (কংগ্রেস)। মোদীর অভিযোগ, স্বাধীনতার আগে ও পরে কংগ্রেসের কর্মকাণ্ড অসম এবং জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী ছিল। প্রধানমন্ত্রী দাবি করেন, ‘কংগ্রেসের পাপের শেকড়’ স্বাধীনতার আগের সময়ে নিহিত, যখন ব্রিটিশ সরকার ও মুসলিম লিগ ভারতের বিভাজনের রূপরেখা তৈরি করেছিল। তাঁর বক্তব্য, সে সময় অবিভক্ত বাংলার সঙ্গে অসমকে যুক্ত করার একটি পরিকল্পনা ছিল, যা পরে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয়। তিনি অভিযোগ করেন, কংগ্রেস সেই পরিকল্পনার অংশীদার হতে এগিয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেই সময়েই অসমের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ নিজের দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে ‘অসমকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। কংগ্ৰেস নেতৃত্বের ওই অপচেষ্টা ব্যর্থ করেছিলেন বরদলৈ। অসমের স্বতন্ত্র পরিচয় রক্ষা করা এবং রাজ্যকে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে বজায় রাখার জন্য গোপীনাথ বরদলৈকে কৃতিত্ব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
রাজনৈতিক পরিচয়ের ঊর্ধ্বে ওঠে জাতীয় ব্যক্তিত্বদের সম্মান জানানোর ব্যাপারে বিজেপির দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করিয়ে দেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার গোপীনাথ বরদলৈকে মরণোত্তর ভারতরত্নে ভূষিত করেছিল।
প্রধানমন্ত্রী আরও অভিযোগ করেন, স্বাধীনতার আগে বরদলৈ অসমকে রক্ষা করলেও স্বাধীনতার পর কংগ্রেস আবার জাতীয় স্বার্থবিরোধী নীতি গ্রহণ করে। তিনি দাবি করেন, ভোটব্যাংক রাজনীতির জন্য কংগ্রেস বাংলাদেশি অভিবাসীদের অবাধে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দিয়েছিল। যার ফলে এই অঞ্চল বড় ধরনের জনবিন্যাসজনিত ভারসাম্য হারিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মতে, অবৈধ অভিবাসীরা বনভূমি দখল করেছে এবং অসমে বিস্তীর্ণ জমি অধিকার করে নিয়েছে। যা রাজ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সামাজিক ও রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
প্রদত্ত ভাষণে তিনি আধুনিক পরিকাঠামোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা এবং অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মানুষের আস্থা পুনর্গঠনের গুরুত্ব তুলে ধরেন। ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অত্যাধুনিক বিমানবন্দর ও উন্নত যোগাযোগ পরিকাঠামো যে কোনও রাজ্যের জন্য নতুন সুযোগের দ্বার খুলে দেয়। তাঁর মতে, এ ধরনের উন্নয়ন একটি রাজ্যের ক্রমবর্ধমান আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলন এবং জনসাধারণের আস্থা আরও দৃঢ় করে।
তিনি বলেন, ‘অসমের বিমানবন্দর ও মহাসড়কগুলো দেখলে আপনিও বলবেন, এখন অসমের প্রতি ন্যায়বিচার হচ্ছে।’ এ প্রসঙ্গে ধলা-সদিয়া, বগিবিলের কথা স্মরণ করিয়েছেন মোদী। একই সঙ্গে তিনি অভিযোগ করেন, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন পূর্বতন সরকারগুলির আমলে অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের উন্নয়ন অবহেলিত ছিল।
বিরোধীদের কটাক্ষ করে প্রধানমন্ত্রী মোদী বলেন, তাঁর সরকার গত ছয়-সাত দশকের ভুল সংশোধন করছে। এই অঞ্চলের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা উল্লেখ করে তিনি যোগ করেন, ‘উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মানুষ আসুক বা না-আসুক, আমি এখানে নিজেকে ঘরের মতোই অনুভব করি।’
প্রধানমন্ত্রী অসমের প্রশাসনিক সাফল্যের প্রশংসা করে জানান, ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বাস্তবায়নে অসম প্রথম স্থানে রয়েছে।
টাৰ্মিনাল উদ্বোধনী সমাবেশে ভাষণ দিয়েছেন আদানি গ্রুপের চেয়ারম্যান গৌতম আদানি। তিনি বলেন, গুয়াহাটিতে তৈরি এই টার্মিনালটি দেখায় কীভাবে স্থানীয় পরিচয়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থেকে দ্রুত বিশ্বমানের বিমানবন্দর পরিকাঠামো গড়ে তোলা যায়। এটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যোগাযোগ আরও মজবুত করবে, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে সমর্থন দেবে এবং যাত্রীদের জন্য একটি নিরবচ্ছিন্ন ও আধুনিক ভ্রমণ অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করবে, বলেন আদানি।
অনুষ্ঠানে ভাষণ দিয়েছেন বিমান পরিবহণ দফতরের মন্ত্রী রামমোহন নাইডু এবং অসমের মুখ্যমন্ত্রী ড. হিমন্তবিশ্ব শর্মা।
হিন্দুস্থান সমাচার / সমীপ কুমার দাস