অশোক সেনগুপ্ত
কলকাতা, ১৫ আগস্ট (হি.স.): স্বাধীনতার ৭৫ বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে প্রকাশ্যে ‘এই উৎসবের বিরোধিতার’ দাবি করলেন বিশিষ্ট আইনজীবী তথা রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশ ভট্টাচার্য। সোমবার সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতায় সূর্য সেন ভবনে ‘বিপ্লবী তীর্থ চট্টগ্রাম স্মৃতি সংস্থা’-র এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে তিনি দাবি করলেন, “আমরা পরাধীনতার পর্বে প্রবেশ করেছি। এ কোন স্বাধীন ভারতবর্ষ?”
বক্তব্যের যুক্তি প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তিনি রাজস্থানে উচ্চবর্ণের শিক্ষকের জলপানের দায়ে অসহায় এক শিশুকে হত্যার সাম্প্রতিক নজীর টানেন। প্রশ্ন করেন, “কেন প্রধানমন্ত্রী বললেন না সামাজিক প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের আরও অনেক পথ যেতে হবে!“ অনুযোগ করেন, “আইনের চোখে স্বাধীন হলেও আসলে আমরা এখনও সামাজিকভাবে স্বাধীন হইনি। মুক্ত হইনি। গণতন্ত্র মানে ভিন্ন স্বরের মুক্ত স্বাধীনতা। প্রতি মুহূর্তে পদদলিত হচ্ছে এই সব সাংবিধানিক অধিকার। মুক্ত চিন্তা, মুক্ত বাক্য, মুক্ত ভাবনার সেই পরিবেশ কোথায়? এমন দেশ তো আমরা চাইনি।“
বিকাশবাবু বলেন, “মোঘল-সুলতানরা ৫০০ বছরের ওপর তারা ভারতে বসেই এ দেশ শাসন করেছে। সম্পদ লুঠ করেনি। কোথায়, বেদ-উপনিষদ তো লুপ্ত হয়নি! গোটা দেশের লোক তাদের বিরুদ্ধে মুখর হয়নি! আর এখন যারা মহোৎসব করছে, তারা ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে মানুষের মনে।“
সংগঠনের সহ সভাপতি ও এশিয়াটিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক ডঃ সত্যব্রত চক্রবর্তী অবশ্য আগে তাঁর ভাষণে বলেন, “হর ঘর তিরঙা এবং আজাদী কী অমৃত মহোৎসব অত্যন্ত জাতীয় চেতনাসম্পন্ন আবেদন। এতে আবালবৃদ্ধবণিতা যেন অংশীদার হতে পারি। তবে, যাঁদের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা পেয়েছি, এই মহোৎসবে মেতেছি, তাঁদের জীবনের দিকে তাকাতে হবে। মনে পড়ছে কোহিমায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত সৈনিকদের একটা স্মৃতিস্তম্ভের কথা। শিলালিপিতে লেখা আছে, বাড়ি গিয়ে আমাদের কথা বোলো। আমরা এখানে জীবন বলি দিয়েছি তাঁদের আগামীকালের কথা ভেবে।”
শ্রীঅরবিন্দর কীর্তি, স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর আবেদনে ওপর সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করে সত্যব্রতবাবু বলেন, “ওঁর ১৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আমরা পৃথক অনুষ্ঠান করব। স্বাধীনতার এই ৭৫ বর্ষপূর্তি কেবল উৎসবে মেতে ওঠার দিন নয়। ফিরে তাকানোর দিন। যাঁরা বলিদান দিয়েছেন, তাঁদের আমরা কতটা প্রতিদান দিতে পেরেছি। কিন্তু নানাভাবে প্রকৃত ইতিহাস থেকে মুখ ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।”
এর সূত্র ধরে বিকাশবাবু পরে বলেন, “চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য সংসদে সওয়াল করতে হয়। এটা লজ্জার। কী অসম্ভব সাহসিকতা দেখিয়েছে ১৪/১৫/১৬ বছরের ছেলেরা! ’৩০-এর চট্টগ্রাম গোটা দেশকে নাড়া দিয়েছিল। প্রথম গেরিলা যুদ্ধের পথ দেখিয়েছিল। নিজেদের প্রমাণ করে দিয়েছিল বাংলার মেয়েরা। মাস্টারদা আর তাঁর তরুণ বাহিনী চট্টগ্রামে প্রথম পতাকা তুলেছিল। জনপ্রিয় হিন্দি সিনেমার বাস্তব প্রয়োগ করেছিল। ওই কর্মকান্ড সংলগ্ন অঞ্চলে একটু সম্প্রসারিত করতে পারলে আরও একটা ভিয়েতনাম হয়ে যেত। অথচ, ওদের সন্ত্রাসবাদী বলে চিহ্ণিত করার চেষ্টা হয়েছে। অসাধারণ মেধা, কীর্তি আর সুযোগ থাকা সত্বেও পুঁটুদি (সুহাসিনী গাঙ্গুলি), কল্পনা দত্তরায়তাঁদের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি পাননি। স্বীকৃতি পেলেন সাভারকার। এগুলো দেখা আমাদের নৈতিক দায়।“
বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন উদ্যোক্তারা। বিষয় ছিল— ’চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ ১৯৩০-’৩৪— ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রভাব’। এদিনের অনুষ্ঠানের পৌরোহিত্য করেন সংগঠনের সভানেত্রী লীলা পুরকায়স্থ। তিনি বলেন, “১০৪টি প্রবন্ধ এসেছিল আমাদের কাছে। এই প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সূর্য সেন ও বিপ্লবীদের সঙ্গে প্রতিযোগী পড়ুয়াদের মানসিক সম্পর্ক দৃঢ় হবে। জীবনমরণ পন করে যাঁরা স্বাধীনতা এনেছিলেন, তাঁদের সম্পর্কে বর্তমান প্রজন্ম জানবে। খুবই দুঃখের অনেকে আজও মাষ্টারদার নাম জানেন না। আমরা এই ভবনে সংগ্রহশালা তৈরির প্রাথমিক কাজ শুরু করেছি। আশা করছি শীঘ্র হয়ে যাবে। বিকাশরঞ্জন আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা অপেক্ষায় আছি। পরবর্তী প্রজন্মের পড়ুয়ারা ইতিহাস জানবে। অন্যথায় তাদের অজ্ঞতার জন্য আমরাই দায়ী হয়ে থাকব। বিপ্লবীদের চিনুক সবাই। তবেই দেশকে জানা যাবে।“
প্রবন্ধ প্রতিযোগিতায় প্রথম তিনটি স্থান পান যথাক্রমে গান্ধী কলোনী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ঋক চ্যাটার্জী, নেতাজীনগর বালিকা বিদ্যামন্দিরের কোয়েল হ হালদার ও এ কে মিত্র ইন্সটিট্যুশন ফর গার্লসের চন্দনা মন্ডল। অংশগ্রহণকারীদের শংসাপত্র দেওয়া হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন কাহারবা, নবনীহারিকা, কসবা সঞ্চারী, বনলতা ও সূর্য সেন ভবনের শিল্পীবৃন্দ। মঞ্চে বিশিষ্টদের মধ্যে ছিলেন সংগঠনের যুগ্ম সম্পাদক অজয় কুমার সেন। সংযোজনা করেন সংগঠনের অপর যুগ্ম সম্পাদক তপন বিকাশ দত্ত।
হিন্দুস্থান সমাচার/ অশোক