অশোক সেনগুপ্ত
কলকাতা, ৩০ এপ্রিল (হি.স.): রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন, “আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে।” তখন তাঁর ৫৩ বছর বয়স। আর ২০২৫-এর জানুয়ারির শেষদিকে
প্রশান্ত মহাসাগর পারে, পশ্চিম আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেসে মদনগোপাল মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা রবীন্দ্রনাথের
অনেক মূল্যবান স্মৃতি পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছে সর্বভুক আগুনের মুখেই।
কবিগুরুর অপ্রকাশিত লেখা, তাঁর বইয়ের প্রথম সংস্করণ ও রবীন্দ্র-চর্চার নানা নিদর্শন, বহু যত্নে আগলে রাখা এক টুকরো রবীন্দ্রনাথ হারিয়ে গিয়েছে আমেরিকার মাটিতে। পেশায় ক্যানসার চিকিৎসক মদনগোপাল মুখোপাধ্যায় দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আমেরিকার বাসিন্দা। তিনি যখন ১৯৬৭ সালে আমেরিকায় পা দেন, ও দেশে কবিগুরুর বই বা রবীন্দ্রসঙ্গীতের রেকর্ড পাওয়া দুষ্কর ছিল।
সমগ্র আমেরিকায় তখন গুটিকয় বাঙালি। শুভশ্রী নন্দী এ কথা জানিয়ে লিখেছেন, “তখন রবীন্দ্রনাথকে আরও কাছে পাওয়ার আর্তি থেকে শুরু হয় মদনগোপালবাবুর রবীন্দ্রসংগ্রহের সুদীর্ঘ ৫৭ বছরের জীবনযাত্রাপথ। এ ব্যাপারে তিনি আমেরিকায় পথিকৃৎ। আমেরিকান সমাজের বিভিন্ন প্রান্তে, নানা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক ভাবে রবীন্দ্রনাথের লেখা ও দর্শনকে ছড়িয়ে দেওয়ার এক অনন্য দায়িত্বপালন তিনি করে চলেছেন এত বছর ধরে।
লস অ্যাঞ্জেলেসে মদনগোপালবাবুর বাড়িতে ছিল অসংখ্য বাংলা বই, পাণ্ডুলিপি ও ছবি। দাবানলে বাড়ির সঙ্গে পুড়ে গিয়েছে সেই সব। চিরতরে হারিয়ে কোন কোন অমূল্য সম্পদ, তার বর্ণনাও দিয়েছেন শুভশ্রী। দাবানল ড্রাগনের মুখের মতো ধ্বংস করে ৪০ হাজার একরেরও বেশি জমি এবং সেখানকার অন্তত ১২০০টি ভবন। সেই সঙ্গে অনেকটা রবীন্দ্রস্মৃতি।
দেশবিদেশে এরকম বীভৎস অগ্নিকান্ডের অসংখ্য নিদর্শন রয়েছে। খাস কলকাতার দিকেই তাকাই। মঙ্গলবার রাতে মেছুয়া বাজারের আগুন এই মুহূর্তে বড় খবর। গত চার দশকে মহানগরীর বিভিন্ন অগ্নিকান্ডের খবর করেছি সাংবাদিক হিসাবে। ফ্ল্যাশব্যাকে দ্রুত মনে ভেসে উঠছে সেসবের স্মৃতি।
সর্বভুক যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে অকুস্থলে সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখেছি নানা সময়। কয়েক দশকে কত জায়গায় কত বস্তি, ঝুপড়ি পুড়েছে তার হিসেব কে রাখে?
১৯৮৫ সালের ১৩ ডিসেম্বর রাত পৌনে ১২টা নাগাদ আগুন লেগেছিল নিউ মার্কেটে। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে সেনাবাহিনী এসে হাত লাগিয়েছিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে। খবর করতে গিয়েছি ক্যামাক স্ট্রিটের বরদান মার্কেট, ফিরপো মার্কেট, ব্রাবোর্ন রোডের চুরিবাজারে। মনে পড়ছে ১৯৯১ সালে এসএন ব্যানার্জি রোডে বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ডের আগুনের স্মৃতিও। পুড়ে ছাই ফটোগ্রাফির আর্কাইভ। ২০১৬ সালের জুন মাসে বন্ধ হয়ে যায় ১৭৬ বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের ওই সংস্থা।
ফিরপো মার্কেটের আগুন লেগেছিল ২০০২-এর ২৩ এপ্রিল। সেটিও মধ্যরাতে। দমকলের ৪০টি গাড়ি গিয়েছিল ঘটনাস্থলে।
২০০৮ সালে নন্দরাম মার্কেটে ভয়াবহ আগুন লেগেছিল। খবর পেয়েই অ্যাসাইনমেন্টে যেতে হয়েছিল। ঘিঞ্জি এলাকায় মার্কেট। দোকানে তো বটেই, সিঁড়ি বা ঘরের সামনে যেখানে যেটুকু জায়গা, তাতেই ঠেসে সাজানো বিক্রির জিনিসপত্র। গোটা বাড়িতে তারের জঙ্গল। প্রচুর লেখালেখি হয়, প্রশ্ন ওঠে প্রশাসনিক গাফিলতি নিয়ে। ঘটা করে তদন্ত কমিটি হয়। ফের ২০১৯-এর ১৪ সেপ্টেম্বর আগুন লাগে ১৩ তলা ওই বহুতলের ১০ তলায়। ১৫ তলা উচ্চতা পর্যন্ত ওঠার উপযোগী আধুনিক ও যান্ত্রিক ল্যাডার থাকা সত্ত্বেও সেটি কাজ করেনি।
২০১০-এর ২৯ মার্চ স্টিফেন কোর্টের আগুন ছিল রীতিমত ভয়াবহ। মৃত্যু হয় ৪২ জনের। ২০১১-র ১২ সেপ্টেম্বর আমরি হাসপাতালের আগুন এ শহরের সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে ভয়াবহ বিপর্যয়। মৃতের সংখ্যা ৯০-এর অধিক। গোটা দেশের আলোড়ন জাগানো অগ্নিকান্ডর তালিকায় ঢুকে পড়েছে এটি।
২০১৩-র ২৭ ফেব্রুয়ারি বড় আগুন লাগে সূর্য সেন স্ট্রিটে। মৃত্যু হয়েছিল মোট ১৯ জনের। ২০১৮-র ১৬ সেপ্টেম্বর রাতে আগুন লাগে দাহ্য পদার্থে ঠাসা বাগরি মার্কেটে। গোটা মার্কেট পুড়িয়ে ছাই করে তারপর থামে লেলিহান শিখা। অসম লড়াইয়ে কার্যত হার মানতে হয় দমকলকর্মীদের। এক এক করে ছ’তলা, চার দিন লেগেছিল সেটি নিয়ন্ত্রণে আনতে। সেখানে নন্দরাম মার্কেটের আগুনের স্মৃতি ফিরিয়ে আনে। ২০২১-এর ৮ মার্চ সন্ধ্যায় বড় আগুন লাগে স্ট্র্যান্ড রোডে নিউ কয়লাঘাট বিল্ডিংয়ের ১৪ তলায়। মারা যান ৯ জন।
দীর্ঘ স্মৃতি আগলে দুই মলাটের নিচে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন উদয়নারায়ণ অধিকারী। রাজ্যের অগ্নিনির্বাপন দফতরের কাজে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৮০-র অক্টোবর মাসে। অবসর নেন ১৯৯৩-এর ৩১ জানুয়ারি।
নন্দরাম মার্কেটে প্রথমবারের আগুন নেভাতে গিয়ে হারাতে বসেছিলেন দুটি চোখের দৃষ্টিশক্তি। কোনওক্রমে তা ফিরে পেলেও বাকি জীবনের জন্য তাঁর সঙ্গী হয়ে যায় ‘Blepharospasm’।
রোগটি কী? উইকি-র ভাষায়, “refers to involuntary twitching or blinking of the eyelids, often characterized by forceful and frequent closure of the eyes. It's a type of focal dystonia, a movement disorder where muscles contract uncontrollably. In severe cases, blepharospasm can significantly impact vision due to the inability to keep the eyelids open.”
দুঃস্বপ্নের স্মৃতির কথা জানাতে গিয়ে উদয়বাবু বুধবার এই প্রতিবেদককে বলেন, “নন্দরাম মার্কেটে আগুন লেগে ছড়িয়ে পড়েছিল পাঁচ তলা থেকে ওপরে ১২ তলা পর্যন্ত। প্রায় ১২ ঘন্টা ধরে যুদ্ধ করছি আগুনের সঙ্গে। তার ধাক্কা এসে পড়ল আমার দুটি চোখে। যেন দৃষ্টিহীন হয়ে গেলাম। কপাল ভালো ছিল, ক্ষতি হয়েছিল চোখের প্রথম স্তরটিতে। চিকিৎসার পর দু’দিন বাদে দৃষ্টি ফিরে পেলেও পুরো স্বাভাবিক হতে পারিনি।”
আজও বুঝি উদয়বাবুকে ধাওয়া করে তপসিয়া-তিলজলার অগ্নিনির্বাপনের স্মৃতি। তাঁর কথায়, “তারিখটা ছিল ২০০৬-এর ২২ নভেম্বর। রাত আড়াইটে নাগাদ খবর পেলাম ক্যালকাটা লেদার ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ আগুন লেগেছে। গিয়ে দেখি কারখানার ভিতরের দরজা তালা দেওয়া। আগুনটা লেগেছিল তার বেশ আগে। দমকল দফতরের কোনও ছাড়পত্র ছিল না। ওই চত্বরে এরকম অবৈধ বেশ কিছু কারখানা ছিল। এখনও সম্ভবত আছে।
কারখানায় প্রচুর রাসায়নিক মজুত থাকত। কাজ চলত মাঝরাতে। কাজশেষে শ্রমিকরা ভিতর থেকে তালা দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ১০ জনের মৃত্যু হয়েছিল ওখানে। বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেলে যেরকম অবস্থা হয়, দেহগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল ওভাবে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ওই অঞ্চলে খুব আতঙ্কের মধ্যে অগ্নিনির্বাপন ও উদ্ধারকাজ করতে হয়েছিল আমাদের।”
এভাবেই আগুন নিয়ে যেন ঘর করি আমরা। বারবার সরকারি ও প্রশাসনিক ব্যর্থতার অভিযোগ, কখনও তৎপরতার কথা উঠেছে। এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দমকলকর্তা এই প্রতিবেদককে বলেন, “সরকার যথেষ্ট তৎপর। ১৯৫০ সালের অগ্নিনির্বাপন আইন অনেক ঢিলেঢালা ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে বহুতল তৈরির হিরিক দেখা যায়। আগের আইনকে ঢেলে সাজিয়ে হয় জাতীয় নয়া অগ্নিনির্বাপন আইন। পশ্চিমবঙ্গ প্রথম সেটি রূপায়ণ করে। তার পর দেশের অন্যান্য রাজ্য আইনের মূল কাঠামো বজায় রেখে নিজেদের মত রূপায়ণ করে। আগুন রুখতে সবচেয়ে আগে দরকার আমজনতার সচেতনতা এবং সংশ্লিষ্ট শিক্ষা। সেটার জন্য জনপ্রতিনিধিদের অত্যন্ত সচেতন হতে হবে। অন্যথায় বারবার অগ্নিকান্ডে প্রাণহানি হবে। ক্ষতি হবে কোটি কোটি টাকার।”
---------------
হিন্দুস্থান সমাচার / অশোক সেনগুপ্ত